নৌকায় ইফতার এবং মরা গরুর ভুঁড়ি

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আমার বাড়ি থেকে তিন চার মাইল পূর্বে যমুনার চরে কিছু পৈতৃক জমি আছে। অনেক দিন হলো সেই জমিগুলো দেখতে যাওয়া হয় না। কিছু জমি বালুচর হলেও বেশিরভাগ জমিতে ধান আছে। আমি ধান ক্ষেতগুলো দেখতে গিয়েছি। সঙ্গে মফিজ ভাই আছেন। তিনি আমার দুর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। বয়সে অনেক বড়। স্থানীয় তহশিল অফিসে চাকরি করেন।

ভাদ্র মাস। রমযান প্রায় শেষের দিকে। আমি নিজেও রোজা আছি। দুপুরের দিকে খেয়া পার হয়ে চরে এসেছি। অনেক চড়া রোদ। গলা শুকিয়ে কাঠ। তারপরেও রোজা নষ্ট করিনি। চরের মাঝামাঝি মফিজ ভাইয়ের চাচার বাড়ি। চাচা কিছুদিন হলো মারা গেছেন। চাচী বর্তমান। চরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষেতগুলো হেঁটে হেঁটে দেখার পর, দুপুরের দিকে আমরা দুইজন সেই বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। দুই জনেই রোযা আছি শুনে চাচী তৎক্ষনাৎ কোন খাওয়ার ব্যবস্থা না করলেও ইফতার পর্যন্ত থেকে যাওয়ার জন্য খুব অনুরোধ করলেন। আমরা থাকতে রাজী হলাম না। কারণ ইফতার করলে রাতে আর বাড়ি ফেরা হবে না। সন্ধ্যার পরে খেয়া নৌকা বন্ধ হয়ে যায়। বিদায় নেয়ার সময় চাচী কিছু মুড়ি আমার গামছার আঁচলে বেঁধে দিলেন। আমি মুড়িসহ গামছাটি ঘাড়ে ফেলে খেয়া ঘাটের দিকে রওনা হলাম। মফিজ ভাই আমার পিছনে।

খেয়া ঘাটে এসে দেখি নৌকা ওপারে। আরো দু’জন লোক পার হওয়ার জন্য বসে আছেন। একজন উচ্চ গলায় লম্বা সুরে খেয়ার মাঝিকে ডাকাডাকি করছেন, ও মাঝি ভাই নৌকা নিয়া আইসো——- ও মাঝি ভাই নৌকা নিয়া আইসো——-। কয়েকবার ডাকডাকি করলেও ওপার থেকে কোন জবাব এলো না। তবে নৌকা ওপারের ঘাটে বাঁধা আছে সেটা দেখা যায়। ভরা নদী। প্রায় এক কিলোমিটারের মত প্রশস্ত।

আসরের নামাযের সময় নৌকা এপার এলো। নৌকা এসেই না ছেড়ে আরো যাত্রী নেয়ার জন্যে বসে রইল। আরো কয়েকজন যাত্রী এসে নৌকায় উঠল। বেলা পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। সবার অনুরোধে অবশেষে নৌকা ছেড়ে দিল। নৌকায় মাঝি মাল্লা দুইজন। একজন হাল ধরেছেন অন্যজন দাঁড় টানছেন। আরো কিছু আলগা বৈঠা ছিল। আমরা দ্রুত ওপারে যাওয়ার জন্য সবাই বৈঠা হাতে নিয়ে টানতে লাগলাম। কিন্তু যত জোরেই বৈঠা টানি না কেন যমুনার ভরা নদীর স্রোতের প্রতিকুলে খুব একটা আগানো সম্ভব হচ্ছে না। মাঝ নদীতে যাওয়ার পরেই ইফতার করার সময় হলো। দূরে মসজিদে আযান শোনা গেল। বেলা ডুবে গেছে। মফিজ ভাই বলল, “বৈঠা টাইনা লাভ নাই, তাড়াতাড়ি সবাই ইফতার করেন। ওপার যাইতে রাইত হইবো। তহন ইফতারী করার সময় থাকবো না”।

মফিজ ভাই ইফতার করতে বলায় মাঝি একহাতে বৈঠা ধরে নৌকার গুলুইয়ে বসেই নিচের দিকে ঝুঁকে অন্য হাতের অঞ্জলিতে নদীর ঘোলা পানি তুলে খেয়ে নিলেন। মাঝির দেখাদেখি আমরাও নৌকার কিনারে বসে নদীর ঘোলা পানি দুই হাতের অঞ্জলিতে তুলে খেয়ে নিলাম। পানি খেয়ে গামছার গাট খুলে নৌকার মাঝি মাল্লাকে দু’মুঠো করে দিয়ে উপস্থিত আরো যে তিনজন যাত্রী ছিল তাদেরকেও দু’মুঠো করে মুড়ি দিলাম।

মুড়ি খাওয়া শেষ হতেই মাঝি আমাকে ডেকে তাদের খাওয়ার জন্য আনা চালের আটা দিয়ে তৈরী চাপড়া ভাজা (লবন, মরিচ, পিয়াজ, রসুন চালের আটার সাথে নরম করে মেখে, সুখনা তাওয়ায় পুরো করে ভাজা) একটা হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি নিতে না চাইলেও তারা জোর করে দিলেন। চাপড়াটি হাতে নিয়ে নৌকার মাঝখানের গুড়ায় বসে, আমি আর মফিজ ভাই অর্ধেক অর্ধেক করে খেয়ে নিলাম। খাওয়ার পর স্রোতের উজানে নৌকার কিনারে বসে দুই জনেই দুই হাত একত্রে করে অঞ্জলি ভরে পানি পান করছি। দুইবার পানি পান করার পর তৃতীয়বার অঞ্জলি ভর্তি পানি তুলে যেই মুখে দিব, অমনি ভুস্ করে দৈত্যের মত বিশাল আকারের গোলগাল কি যেন আমার সামনে ভেসে উঠল। আমার থেকে মাত্র দুই হাত উজানে হঠাৎ ভুস্ করে ভেসে উঠায়, ভয়ে ‘ওরে বাবারে’ চিৎকার দিয়ে এক লাফে কিনার থেকে নৌকার মাঝে চলে এলাম। আমার চিৎকারে সবাই চমকে উঠল। পিছনের মাঝি কাছেই ছিলেন। তিনি ধমক দিয়ে উঠলেন, এই ছাওয়াল, চিক্কুর দেও ক্যা?
আমি বললাম, ওই দেখেন, কি যেন ভাইসা উঠছে?
মাঝি তাকিয়ে দেখে বললেন, ওইডা কিছু না, ওইডা মরা গরুর ভুঁড়ি। ওইডা দেইখাই আতকা চিক্কুর দিয়া উঠলা। মরা গরুর ভুঁড়ি এর আগে দেখো নাই?
আমি বললাম, দেখছি, তবে এতো বড় ভুঁড়ি দেখি নাই!
মাঝি বলল, আরে বাবা, গরুর ভুঁড়ি এতো বড় না, পানিতে থাইকা পঁইচা ফুইলা-ফাইপা এতো বড় হইছে।

মাঝির কথায় সাহস পেলাম। কিন্তু যত না সাহস পেলাম তার চেয়ে বেশি বিপদে পরলাম ভুঁড়িটি নদীর স্রোতে নৌকার উজান পার্শ্বে এসে আটকে গেছে। ভুঁড়ির পঁচা গন্ধে নাক মুখ চেপে ধরেও টেকা মুশকিল। মফিজ ভাই ভাটির দিকে নৌকার বাইরে মুখ নিয়ে ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে লাগলেন।

মফিজ ভাইয়ের দেখাদেখি আমারও বমি বমি লাগছে। ভুঁড়ির গন্ধের জন্য নয়, ভুঁড়ির পঁচা-গলা ধুয়ে আসা পানি একটু আগে আমরা দুইজনেই পান করেছি। সেই কথা মনে হতেই পেটের নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসার অবস্থা। বমি বমি ভাব হলো বটে তবে নাক-মুখ চেপে ধরায় বমি হলো না।

মাল্লা নৌকার সাথে লেগে থাকা ভুঁড়ি ছাড়ানোর জন্য জোরে জোরে দাঁড় টানতে লাগলেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হলো না। ভুঁড়ি নৌকার সাথে সাথেই চলতে লাগল। অবশেষে মাঝি হাল ছেড়ে দিয়ে নৌকার মাঝে এসে বৈঠা দিয়ে ঠেলে ভুঁড়ি ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হলেন। পঁচা-গলা ভুঁড়ির যেখানে বৈঠা দিয়ে ঠেলা দেয় সেখানেই ঢুস করে ছিদ্র হয়ে আরো দুর্গন্ধ বের হয়। অগত্যা মাঝি যাত্রীদের একজনকে হাল ধরতে বলে, নিজে শক্ত করে লুঙ্গি মালকোছা মেরে তৈরী হয়ে নিলেন। এবার ভুঁড়ির উপরে বৈঠা আড়াআড়িভাবে রেখে, দুই হাতে বৈঠার দুইপাশে ধরে যাতা দিয়ে পানির নিচে ডুবিয়ে নৌকার তল দিয়ে ভাটির দিকে দেয়ার চেষ্টা করলেন। এতে আরো বিপদ হলো। ভুঁড়ি নৌকার তলে গিয়ে উপর দিকে ঠেলে উঠল। নৌকা একদিকে কাত হয়ে গেল। ভয়ে নৌকার যাত্রী সব আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগল। ভরা নদীর অথৈ পানিতে যদি নৌকা ডুবে যায় নির্ঘাত মরণ ছাড়া উপায় থাকবে না! এতো বড় নদী সাঁতরে স্রোতের প্রতিকুলে কিনারে যাওয়া সম্ভব নয়।

অনেকেই ধরে নিল এটা আর কিছু নয় গভীর জলের দৈত্য ভুঁড়ির সাথে এসেছে। ভয়ে সবাই দোয়া দরুদ পড়া শুরু করে দিল। দাঁড়ির মাল্লা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে জোরে দাঁড় টানতে লাগলেন কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হলো না। নৌকা যত না সামনে আগায় তারে চেয়ে ভাটির দিকে বেশি যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে হালদার মাঝি বললেন, আপনারা সবাই বৈঠা ধরেন, আমি ‘লা-ইলাহা’ বললে আপনারা ‘ইল্লাললাহ’ বলে বৈঠায় টান দিবেন। মাঝির কথায় যাত্রীরা সবাই মিলে বৈঠা বাইতে লাগল। সবাই মিলে বৈঠায় টান দেয়ায় নৌকার গতি কিছুটা বড়লো বটে তবে যেই পরিমান গতি হওয়ার কথা তত হলো না।

আস্তে আস্তে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এলো। নদীর এপার ওপার কিছুই দেখা যায় না। নদীর স্রোতে পাঁক খাওয়া পানির কুল কুল শব্দ কখনও কখনও কল কল করতে করতে সোঁ সোঁঁ করে উঠে। শব্ধগুলো ভয়ঙ্কর কিছু একটা মনে হয়। স্রোতের সাথে ভেসে আসা কচুরি পানা বা বিভিন্ন বস্তুর চেহারা অন্ধকারে ভুতের মত মনে হয়। রাতের অন্ধকারে এতো বড় নদীর মাঝে এমন ভুতুরে অবস্থায় আর কখনও পড়ি নাই। বৈঠা টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি কিন্তু কিনার পাচ্ছি না। মাঝির কথামত “লাইলাহা ইল্লাললাহ, লাইলাহা ইল্লাললাহ” বলে বৈঠা টানতে টানতে অনেক সময় পর পাড়ের কাছাকাছি চলে এসেছি। এমন সময় হিড়িস করে নৌকার গতি বেড়ে গেল। সাথে সথে কাত হওয়া নৌকা সোজা হলো। অবস্থাটা এমন মনে হলো কেউ নৌকা টেনে ধরে রেখে হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলে যে অবস্থা হয় তেমন অবস্থায় নৌকার গতি বেড়ে গেল। একটু পরেই নৌকা কিনার পেল। যে ঘাটে নৌকা ভেড়ার কথা তার চেয়ে আধা মাইল ভাটিতে এসেছি। নৌকা ঘাটের চেয়ে অনেক ভাটিতে গেলেও পারে ভেড়ায় সবাই স্বাস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অনেক যাত্রীর ভাব দেখে মনে হলো, মুত্যুর হাত থেকে যেন কোন রকমে জানে বেঁচে এসেছে। নৌকা আরেকটু ভাটিতে নিয়ে সুবিধা মত পাড়ে ভিড়ালে তড়িঘড়ি করে যে যার মত নৌকা থেকে নেমে গেলো।

সবাই নামার পরে মাঝি বললেন, “ভাই আপনারা কিছু কি বুঝছেন? আমি কিন্তু বুইঝা ফালাইছি, একে তো আমাবশ্যা তার উপর কালি সন্ধ্যা, শালা শয়তান ভর করছিল। ভাগ্য ভালো আমরা সবাই রোযাদার আছিলাম। আল্লার জিকিরের ঠেলায় শালা শয়তান সুবিধা করবার পারে নাই”।

মাঝির কথা শুনে ভয়ে আঁতকে উঠলাম। শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। ভাগ্য ভালো মাঝি নৌকায় থাকাকালীন ঘুনাক্ষরেও এসব কথা বলে নাই। বললে ভয়ে অনেকেই জ্ঞান হারাতো। মাঝিকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। কারণ ভুতের কথা না বলে বরঞ্চ সবাইকে উৎসাহমূলক কথা বলে সাহস জুগিয়েছেন।

নৌকা থেকে নেমে আমরা আর সেখানে দেরি করলাম না, তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

ছবি ঃ গুগল

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *