দগ্ধ হৃদয় (নবম র্পব)

ইসহাক আলী প্রামানীক
ধীরে ধীরে সূর্য্য অস্ত গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সমস্ত আকাশ নীল হয়ে এসেছে, ফসলের মাঠ আধারে ঢেকে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন শরৎ দেবী স্বর্গ হতে এলোকেশী হয়ে কবরী ছড়িয়ে দিয়ে তার শাড়ীর আঁচল মর্তে বিছায়ে দিয়েছে। দেখতে দেখতেই যেন আধারে ছেয়ে রজনীতে পরিণত হয়ে গেলো। ইনামুল বসে বসে সময় কাটাছে, কখন রজনী গভীর হবে, তাহলে হাসিনার সাথে দেখা করতে যেতে হবে।

তারপর ইনামুল বই খুলে পড়ার চেষ্টা করলো কিন্তু না মন বসছে না। শুধু বিগত রাতের ঘটনার কথা বার বার ফিরে আসছে মনে। করিম মিয়া সেদিন তাদেরকে দেখে ফেলেছে। এই ভয়ে এবং লজ্জায় তার সামনা সামনি এখনও হতে পারে নি। কিন্তু আবার যাবো সেখানে। মনে হয় যাওয়া ঠিক হবে না। হয়ত সে ওৎপেতে থাকবে আমাদের ধরার জন্য। যদি দেখে ফেলে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে তখন। আব্বা শুনলে কিছু যদি করে বসেন, কিংবা বাড়ী থেকে বেড় করে দেন। তাহলে তো আর সমাজে মুখ দেখানো যাবে না।
আমাদের দুজনের ভালবাসা কি শেষ হয়ে যাবে। যদি আমরা দুজনের ভালবাসা অক্ষত রাখলাম কিন্তু করিম মিয়া কি তা মেনে নিয়ে বাস্তবে রূপ দেবেন। সে যদি জোড় করে অন্যত্র বিয়ে দেয় তখন কি হবে। নানা এসব আমি কি ভাবছি। আমাদের মিলন হবে যদি আল্লাহ সহায় থাকেন। আল্লাহ নিশ্চয় আমাদের জন্য মিলন রেখেছে।
সব বাধা চিন্তা ফেলে আমাকে অবশ্যই আজ হাসিনার সাথে দেখা করতে হবে। হাসিনার সাথে কথা বলে আমাদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্তের কথা ঠিক করতে হবে। হাসিনা আমাকে সত্যিকারেই ভালবাসে কিনা ! না মিছামিছা ভাললাগার ভান করে তাও শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নানা চিন্তার মাঝে কে যেন তাকে ডেকে গেলো। হকচকিয়ে চিন্তার জাল ছিন্ন করে মাথা ফিরে চেয়ে দেখে তার বড় ভাবী।
-এই কিসের চিন্তা এতো তোমার?
-কই নাতো ?
-তবে যে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছো?
-ও এমনি ভাবী।
-এমনি এমনি কেউ চিন্তা করে। না কলেজে কোন মেয়ের রূপে মনে আঘাত লেগেছে তোমার।
-ধ্যাৎ ভাবী কি যে বলেন না।
-আমার কাছে লজ্জা কিসের?
-আপনি যাই বলুন না কেন ভাবী? আমার মনে ওসবের একটিও নেই।
-আচ্ছা তাহলে উঠে এসো খাবে। খাবার হয়ত এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেলো।
-আচ্ছা চলুন। উভয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো।

খাওয়া শেষ করে ইনামুল আবার চিন্তা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সে ঘড়ি দেখে নিলো। এখন সাড়ে দশটা বাজে। আরো দেড় ঘন্টা বাকী। বারোটায় যেতে হবে। তাই একটা গল্পের বই খুলে দেখতে লাগলো। এমন সময় ইনামুলের মা এসে ইনামুলকে ডেকে বললো
-কিরে এখনো ঘুমোস নি কেন? রাত যে অনেক হয়েছে। কাল আবার রাতে ট্রেনে ঘুম জাগতে হবে।
-ঠিক আছে মা ঘুমাচ্ছি।
-এক্ষনি ঘুমা, আর রাত করিসনে।
-এই বলে ইনামের মা চলে গেলো। কিন্তু ইনাম ঘুমের ভান করে বিছানায় গাটা এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়তে ছিল। তাই সে উঠে তাড়াতাড়ি ঘড়ি দেখলো, দেখে রাত পৌনে বারোটা। আরো পনেরো মিনিট বাকী। কিন্তু ইনামের আর বিলম্ব সইলো না। তাই বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে বেড় হলো।

গভীর রাত সে কেমন করে বাড়ী পিছন দিয়ে বাড়ীতে ঢুকবে। ঢোকার সময় যদি কেউ দেখে ফেলে তখন কেমন হবে? যদি চীৎকার দিয়ে সকলকে জানিয়ে দেয় তখন কি হবে? ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে উত্তর পার্শ্বের গেট দিয়ে ঢুকে পড়লো কিন্তু এখানে যে কঠিন অন্ধকার। এখানেতো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এইতো সামনেই হাসিনার কক্ষের পিছনের দরজা। এই দরজা দিয়ে বেড় হয়ে হাসিনার তো এখানে দাড়িয়ে থাকার কথা। কিন্তু সে নাই কেন? নাকি সে দাড়িয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। না সে ঘুমোবেই বা কেন? আমিতো তার কথা মতোই ঠিক সময়ে এসেছি।
একটু চিন্তা করে, তবে কি ওর দরজায় নক করবো। না মনে হয় ডাক দেয়া ঠিক হবে না। অন্য কেউ জানতে পারলে বিপদ হতে পারে। এর মধ্যেই হাসিনা দরজা চুপি চুপি খুলে বাইরে এলো। দেখে কে যেন দাড়িয়ে আছে।
– কে ? মৃদুস্বরে।
– আমি এনামুল।
-আপনি এসেছেন ?
-হ্যা এসেছি।
হাসিনা এগিয়ে এসে চুপি চুপি বললো এখন কোথায় বসা যায়?
-আচ্ছা তুমি আমার পিছনে পিছনে আসো। তারাপর উভয়ে পিছনের গেট দিয়ে বাড়ীর বাহিরে চলে এলো। তারা উভয়ে নদীর তীরের নিকট খোলা মাঠে যেখানে কদম গাছ আছে, তার নীচে।
-কিন্তু ওটাতো রাস্তার ধারে। চলার পথে কেউ দেখে ফেলে।
-কোন ভয় নেই এতো গভীর রাতে কোন লোক আসবে না। তাছাড়া রাস্তাটিতো থাকলো ডান পাশে।-তবু আমার ভয় হচ্ছে। ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না।
-আরে ভয় নেই কদম গাছের চারিদিকে নতুন ঝাউবন দেখা যাবে না।
-যাই বলুন গভীর রাতে ওখানে বসা ঠিক হবে না।
-ধ্যাত এতো ভয় কর কেন? এই তো কদম গাছ।
এই বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো হাসিনাকে।
চারিদিকে জন কোলাহল শূন্য এবং নিস্তব্ধ। আকাশে অজ¯্র তারার মেলা। তাদের আগমনে মনে হচ্ছে তারাগুলি আরো ঝল মল করে উঠছে। মনে হচ্ছে প্রেমিক প্রেমিকাকে তারকারাজি স্বাগতম জানাচ্ছে। কোন কোন পাখি পিউ কাহা বলে সম্বোধন জানাচ্ছে। এতরাত জেগে তারা স্বাগতম জানাচ্ছে তাদেরকে।
কদম গাছের চারিপাশ পরিষ্কার কারণ রাখালেরা গরু চড়াতে আসে, আর এখানে বসে বিশ্রাম নেয়। তাই জায়গাটি পরিস্কার করে রাখে ওরা।
-আচ্ছা আপনি এই দুইদিন আসেন নি কেন?
-সেটা তুমি ভালো জানো কেন আসিনি?
-আপনি কি সব কথা জানেন?
-হ্যা। কারণ আমি তোমাদের ঘরের বাইরে দাড়িয়ে ছিলাম।
-তাহলে চাচার সবই শুনেছেন?
-জী হা: সবই শুনেছি।
-তাহলে তো আপনি দিনে অন্ততঃ একবার করে আসতে পারতেন। কারণ দিনে তো আর আসতে নিষেধ করেনি আপনাকে।
-তা ঠিক। কিন্তু কিছু বলে বসতে পারে তাই ভয়ে নিজকে সংযত করেছি।
-আপনার জন্য আমি খুবই ব্যকুল ছিলাম, তাই বাধ্য হয়ে চিঠি লিখেছি।
তারপর উভয়ে কিছুক্ষণ চুপ চাপ রইল কোন কথা নেই। মৃদু মৃদু বাতাস বইচে, ঝাউগাছ গুলো দোল খাচ্ছে। নদীর পানি কুল কুল রবে বয়ে যাচ্ছে। তাদের মনে প্রাণে যেন একটা নুতন আমেজ দোল খাচ্ছে।
-হাসিনা ?
-উ:
-কি ভাবছো?
-কই কিছুই না ।
-তবে যে কিছু বলছো না।
-আপনি তো কিছু বলছেন না,
-তাই।
-আচ্ছা আপনি বলুন তো আপনার জন্য আমি কি এনেছি।
-যদি বলি তবে কি আমাকে দেবে?
-হ্যা যদি ঠিক করে বলতে পারেন, তবে নিশ্চয় পাবেন। নইলে দেবো না।
-ইনাম জানে ও গভীর রাত্রে এই নির্জন ঝাউ কাননে হাসিনা কি এনেছে। সে তার বুক ভরা যৌবন ও হৃদয় ভরা ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই আনতে পারেনা। তাই ইনামুল হাসিনাকে বললো,
-আমি জানি তুমি হৃদয় দিয়ে ভালোবাস। এই কদম তলে এগভীর নিশিতে তোমার যৌবন ও ভালবাসা আমার হাতে তুলে দেয়ার জন্য এনোছো। ঠিক বলেছি না।
-তখন হাসিনা ইনামুলকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ঠিক বলেছেন। একদম সত্যি কথা বলেছেন।
-তাহলে আমাকে এখন দাও।
-মিষ্টি হেসে হাসিনা বললো, আমি দিয়েছি তুমি গ্রহণ করে।
-ঊভয়ে উভয়ের বুকে লুটে পড়লো।
পূর্বেও ছুলে বলে হাসিনার হাত স্পর্শ করেছে ইনামুল অনেক বার। কিন্তু আজকের মত এতো তৃপ্তি পায়নি সে। আজকে যেন নারী স্পর্শ তাকে মোহিত করেছে। এ এক অপূর্ব অনুভূতি, যা সে আশা করেনি কখনও। তার শরীর মনে যেন শিহরণ হচ্ছে। হাসিনাতো তার যৌবন বিলিয়ে দিতে চাচ্ছে, সেখানে ইনামুল নিরব। আজ উভয়ের দেহ মন অপূর্ব অনুভূতিতে এককার হয়ে গেছে। এরপর তারা উভয়ে আলিঙ্গন যুক্ত হয়ে পড়লো।
-তুমি কি আমাকে সত্যি ভালোবাসো হাসিনা।
-নইলে কি ডেকে এনে এমনিতেই সব উজার করে দিতে চাই। এখনও বিশ্বাস হয়নি?
-হ্যাঁ হয়েছে। অনেক পূর্বে থেকেই তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছি।
-কিন্তু তুমি আমাকে ভালবাসতে চাও না তাই না।
-দেখ হাসিনা ও কথা মুখে আনতে নেই। এই রজনীতে আকাশের সমস্ত তারা স্বাক্ষী, বৃক্ষরাজী স্বাক্ষী, স্বাক্ষী এই কদম গাছটিও। জানি না বিধি কার ভাগ্যে কি রেখেছে। আমি সত্যি করে বলছি জীবনে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে জীবন সঙ্গি করবো না। যদি না পাই তোমাকে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাব সারা জীবন তোমার তপস্যা করে যাবো। সবই খোদার হাতে।
থামুন। কেন এমন ধারনা আপনার। আমিতো আপনাকে ছাড়া আর কাউকে জীবনে চাইনে। স্কুল জীবন হতেই আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তখনও আমার শরীর মনে যৌবনের কোন মোহন বিলাস দেখা দেয়নি। কিন্তু যখনই যৌবনের ঢেউ আরম্ভ হয়েছে, তখনই তোমাকে আমার আপন দেহ বিলিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। তাই আজ সময় এসেছে আমার ইচ্ছা পুরণ করার। শপথ নিলাম রজনীকে স্বাক্ষী রেখে যদি তোমাকে জীবনে না পাই তবে তোমার নামে মালা গেথে জীবন বিসর্জন দিবো। আর কি বলতে বলো তুমিÑ আমাকে কি নিয়ে শপথ করতে হবে বলো আমি প্রস্তুত আছি। আমি তোমাকে আপন করে সারা জীবন ঘর করতে।
-সত্যি হাসিনা আজ তুমি আমাকে বিস্মিত করে তুললে,
-আমার মনে আজ তুফান উঠেছে, তোমার চোখে চোখ আর বুকে বুক রেখে সময় কাটাতে। তোমাকে আজ পর নয়, আপন জন বলে মনে হচ্ছে। খোদা কি আমার সাধনা আশা কিছুই পুরণ করবে না?
-তারপর ম্যাচ জ্বালিয়ে ইনামুল ঘড়ি দেখে-হাসিনা উঠ রাত প্রায় দুটো বাজে। আমাকে যে ঘুমোতে হবে নইলে কাল ঢাকা যেতে ট্রেনে অসুবিধা হবে।
-তুমি কি কালই যাচ্ছ ?
-হ্যা কালই যাচ্ছি।
-তবে তোমার ঠিকানা দিবে।
-ঠিকানা নিয়ে কি করবে। চিঠি উত্তর দেওয়া যে দুস্কর।
-না হয় ভাবীর মাধ্যমে পত্র আদান প্রদান করবেন।
সে কিছু মনে করবেন না।
-আচ্ছা তাই হবে। তবে ভাবীর নিকট থেকে ঠিকানাটাও নিয়ে নিবে।
-ঠিক আছে।
-তারপর ঊভয়ে উঠে পড়লো। হাত ধরে হাসিনাকে ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে, দ্রুত নিজ বাড়ীর দিকে এগুতে থাকে ইনামুল।
-ইনামুল আজ হাসিনার কথা ও ব্যবহারে অভিভূত, সে তো এটাই আশা করেছিল হাসিনার কাছে। আমি হাসিনাকে নিয়ে ঘর করবো। ওকে বিয়ে করবো, মাকে বিষয়টা জানাতে হবে। ওকে আমার জীবনে চাই। তবে আমার জীবন সার্থক হবে। আমার জীবন হবে পূণ্য॥

চলবে- – –

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *