একটি মনিপুরি পরিবারের আতিথেয়তা এবং সিলেট ভ্রমণ
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
মনিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজন এতো অতিথি পরায়ন হয় এটা আমার আগে জানা ছিল না। না জানার কারণও আছে– আগে কখনও এই সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে মেশার সুযোগ হয় নাই, বই পুস্তকেই যা জ্ঞান লাভ করেছিলাম ততটুকুর মধ্যে জ্ঞান সীমাবদ্ধ ছিল। গত এক দশক হলো ঢাকায় একই বিল্ডিংয়ে বসবাস করার কারণে সুরজিত কুমার সিনহা নামের একজন ভদ্রলোকের সাথে প্রথমে ক্যান্টিনে পরিচয় এবং পরিচয় থেকেই বন্ধুত্ব। রাতের ডিনারে প্রায় প্রত্যেক দিনই দুইজন একই টেবিলে বসে ডিনার করে থাকি। ডিনার টেবিলে একত্রে ডিনার করতে করতে দুইজনের বন্ধুত্ব এমন এক পর্যায়ে যে, একজনের ডিনারে উপস্থিত হতে দেড়ি হলে আরেকজন অপেক্ষায় বসে থাকতাম এক সাথে ডিনার করার জন্য। ধর্মের ভিন্নতা থাকলেও আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক মতের কখনও অমিল হয় না।
গত বছর সিলেটে পরিবার নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে সুরজিত বাবু ট্রেনের টিকিট কাটা থেকে শুরু করে সিলেটের হোটেল বুকিং পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন। তার এই সহযোগীতা ভুলে যাবার মত নয়। কিন্তু বিধিবাম হওয়ায় টিকিট কাটার পরও যাওয়া হয় নাই। যাওয়ার উদ্দেশ্যে পুরো পরিবার নিয়ে এয়ারপোর্ট স্টেশনে সকাল থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত বসে থেকেও সিলেটের কোন ট্রেন না পেয়ে অবশেষে টিকিটের টাকা ফেরৎ নিয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছিলাম। ট্রেন এক্সিডেন্টের কারণে সিলেটের সাথে ২৬ ঘন্টা ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। সারাদিন স্টেশনে বসে থাকলেও স্টেশন থেকে আমাদের ট্রেন এক্সিডেন্টের সামান্যতম বার্তাটিও দেয়া হয় নাই। যখনই স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করেছি ট্রেন কতদূর– তখনই স্টেশন মাস্টার উত্তর দিয়েছে এই তো, আধ ঘন্টার মধ্যে ট্রেন চলে আসবে। ট্রেন যে এক্সিডেন্ট করেছে একথা একবারও তিনি বললেন না। আমরাও স্টেশন মাস্টারের কথা অন্ধের মত বিশ্বাস করে বসে ছিলাম। সেইদিন স্টেশনে বসে আমিই শুধু কষ্ট করি নাই আমার মত হাজার হাজার যাত্রী কষ্ট করেছিল। আমার বাসা ঢাকা শহরে হওয়ায় সহজেই বাসায় ফিরতে পারলেও অনেক যাত্রী রংপুর দিনাজপুর থেকে এসে আটকা পড়েছিল। প্রথম শ্রেণীর ওয়েটিং রুমে বাচ্চাকাচ্চাসহ দিনাজপুর থেকে আসা একটি পরিবারের মুখগুলো আজো চোখে চোখে ভাসে । তারা দিনাজপুর থেকেই অনলাইনে সিলেট পর্যন্ত টিকিট কেটেছিল। বাচ্চাগুলো বাসে বমি করে দেখে ট্রেনে যাত্রা করে মাঝ পথে আটকা পড়েছে। না যেতে পারছে দিনাজপুর না যেতে পারছে সিলেট। বাসায় ফিরে টিভিতে স্ক্রল দেখে টের পেলাম আখাউরার কাছে ট্রেন সকালেই এক্সিডেন্ট করেছে। ট্রেন এক্সিডেন্ট করলেও যাত্রীদের বলা যাবে না ব্রিটিশদের দেয়া সেই নিয়মটি বর্তমানেও বাংলাদেশ রেলওয়েতে চালু আছে।
এবার সুরজিত বাবুকে না জানিয়েই সিলেট এসেছি। কারণ গতবছর না যাওয়ার কারণে বুক করা হোটেল ক্যানসেল করতে হয়েছিল। এই
কাজটি তিনিই করেছিলেন। সেই ভোগান্তির কথা চিন্তা করেই এবার তাকে জানাইনি। সিলেট এসে ফোন করে যখন জানালাম তখন তিনি কিছুটা আশ্চর্যই হয়েছিলেন। তবে তেমন কিছু বললেন না শুধু আমার কাছ থেকে হোটেলের নাম ঠিকানা আর রুম নাম্বার চেয়ে নিলেন। রুম নাম্বার দেয়ার পর আর কোন কথা হলো না। পরদিন হুট করেই দেখি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন, ফোন রিসিভ করতেই অল্প বয়সি কণ্ঠে বলল– আঙ্কেল, আমি তো আপনার হোটেলের নিচ তলায় বসে আছি। আমি চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম– তুমি কে? ছেলে ঝটপট উত্তর দিল, আমি সুরজিত বাবুর ছেলে সৌমিত্র। আমি থ হয়ে গেলাম, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সুরজিত বাবুর ছেলেটি বেশ আন্তরিক, সকালে আসার পর থেকে প্রায় সারাদিনই আমাদের সাথে সঙ্গ দিয়েছে। চা বাগানসহ পুরো সিলেট শহর ঘুরিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। ছেলের এই সহযোগীতা কোন দিনই ভুলবো না। দুপুরে পানসী হোটেলে লাঞ্চ সেরে তাকে বিদায় দিয়ে আমরা হোটেলে রেস্ট নিচ্ছিলাম। সন্ধার সময় দেখি ছেলেটি আবার এসেছে। এসেই বলতেছে আঙ্কেল, মা আপনাদের নিয়ে যেতে বলেছে। তাদের বাসায় যাবো এবিষয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদের আগ্রহ প্রচুর। তাদের আগ্রহের কারণ হলো মনিপুরিদের ঘর বাড়ি দেখা। তাদের আগ্রহের কারণেই সন্ধার পরপরই রওনা হলাম। হোটেল থেকে খুব দূরে নয়।
বাসায় পৌঁছলে সুরজিত বাবুর স্ত্রী এবং ছোট ভাই রবীন্দ্র সিনহা আমাদের বাড়ির গেট থেকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। সুরজিত বাবুর স্ত্রী সরাসরি উনার বেড রুমে নিয়ে আমাদের বসতে দিলেন। জীবনের প্রথম পরিচয় এবং প্রথম দেখাতেই অন্দর মহলে নিয়ে বসাবে এটা কল্পনাও করতে পারি নাই। রবীন্দ্র ভালো বাংলা বলতে পারলেও সুরজিত বাবুর স্ত্রীর বাংলা উচ্চারণ পুরোপুরি শুদ্ধ নয়। ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে। তবে বলার স্টাইলটা আমার কাছে বেশ ভালই লাগতেছিল। কথা যেভাবেই বলুক না কেন তাদের আন্তরিকাতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মেয়ে স্বস্তিকা মুহুর্তই আমার ছেলে মেয়ের সাথে মিশে গল্প গুজোবে মত্ত হয়ে গেল। রবীন্দ্র সিনহার মেয়ে শ্রেষ্ঠার কথা তো ভুলতেই পারছি না। পুতুলের মত সুন্দর ছোট মেয়েটির চঞ্চলতার দৃশ্য এখনও চোখে চোখে ভাসে। পুরো পরিবারটাই বেশ আন্তিরিক।
পরিচয় পর্ব শেষ হতে না হতেই খাবার এনে হাজির। অনেক কিছুই খাবার দিয়েছে, তার মধ্যে গরম গরম লুচি এবং মনিপুরি স্টাইলে রান্না করা ডালের তুলনা হয় না। ডালের মধ্যে কিসের যেন পাতা দিয়েছে, পাতাগুলোর কারণে ডালের স্বাদ অনেক বেড়ে গিয়েছে। এইরকম স্বাদের ডাল আমার জীবনে আর কখনও খাই নাই। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই রবীন্দ্র তার ঘরে গিয়ে হাতে বোনা দু’টি উলের মাফলার এবং সুরজিত বাবুর স্ত্রী তার নিজের হাতে বোন উলের চাদর এনে আমার স্ত্রীকে গিফট করলেন। তাদের গিফট করা দেখে আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। বস্ত্র দান করা এটা নাকি তাদের অতিথী আপ্যায়নের একটি অংশ। তাদের কৃষ্টি কালচার সম্পর্ক-এ আমার তেমন একটা ধারনা না থাকলেও তাদের সহজ সরল মনের অতিথী আপ্যায়ন দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তারা আমাদের এমনভাবে আপন করে নিয়েছিলেন যেন আমরা তাদের যুগযুগ ধরে পরিচিত এবং খুবই আপন কেউ। বাংলাদেশের বুকে এইরকম আন্তরিকতাপূর্ণ সহজ সরল মনের কমউনিটিগুলো যুগযুগ ধরে বেচে থাক আমি এই কামনাই করি।
Recent Comments