ভূতের আলো
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
সম্ভাবত ঘটনাটি ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে। অগ্রাহায়ন মাসে ছোট ফুফু আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। ফুফুর সাথে আমার সমবয়সী ফুফাতো ভাই সামুরুদ্দিও এসেছে। সামুরুদ্দিকে আমরা সংক্ষেপে সামু নামে ডাকি। আমার লেখার ফাউন্টেন পেন নষ্ট হয়ে গেলে আমি ওকে খেলতে দিয়েছিলাম। সামু কলমের মাথার রিং কলম থেকে খুলে আংটির মত বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে পরেছে। আঙ্গুলে ঢুকতে চায় না তারপরেও জোর করে ঢুকিয়ে দিয়ে একটু পরেই কান্নাকাটি শুরু। পাতলা টিনের চিকন রিং জোর করে হাতে পরার ফলে রিং আঙ্গুলের ভিতর চিপে বসেছে। শত চেষ্টা করেও রিং আর খুলতে পারছে না। রিং খোলার জন্য যত চেষ্টা করছে তত আঙ্গুল কেটে চামড়া ছিলে রক্ত বের হয়েছে। সামুর কান্নাকাটিতে ফুফুসহ অনেকেই আঙুল থেকে রিং বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ। অবশেষে কামার বাড়ি গিয়ে টিন কাটার কাঁচি দিয়ে রিং কেটে এই বিপদ থেকে সামুরুদ্দিকে রক্ষা করা হয়। রিং কাটার সময় আঙুলের অনেকখানি চামড়া ছিলে গেছে। ব্যাথায় সামুরুদ্দি অনবরত ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদছে।
সন্ধার দিকে সামুর আঙুল আরো ফুলে গেলে ব্যাথায় গায়ে জ্বর আসে। ফুফু সামুকে কোলে নিয়ে বাহির বাড়িতে হাঁটাহাটি করছে। সন্ধ্যা পার হয়ে রাত্রির অন্ধকার নেমে এসেছে। অন্ধকারে দূরে কোথাও কিছু দেখা যায় না। আমরা পূর্বদিকের ঘরে বসে লেখাপড়া করছি। এমন সময় ফুফু আমাদের ডাক দিয়ে বলল, বাবু, মনা, মনি তোরা তাড়াতাড়ি বাহির বাড়িতে আয়, দেইখা যা এইটা কি যায়?
ফুফুর কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি বললাম, কি যায় ফুফু?
ফুফু বলল, একটা নীল আলো কেমনে লাফাইতে লাফাইতে দক্ষিণ দিকে যাইতেছে।
আমরা চার ভাইবোন দৌড়ে বাহির বাড়ির উঠানে ফুফুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফুফু হাত দিয়ে দক্ষিণ দিকে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ, কিসের আলো যেন ক্ষেতের ভিতর দিয়ে লাফায়া লাফায়া যাইতেছে।
ফুফুর কথামত আমরা চেয়ে দেখি সত্যিই একটি আধা উজ্জ্বল নীলাভ আলো উপর নিচে লাফাতে লাফাতে ঠিক মাটির একফুট উপর দিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে আলোটি খুব দূরে নয়, দু’তিন শ’ গজ হবে।
আমার বড় ভাই ডাক দিয়ে বলল, এই কিসের আলো যায় রে?
বড় ভাইয়ের একথা বলার সাথে সাথে আলো নিভে গেল। অনেকক্ষণ আর জ্বলল না। প্রায় এক দেড়শ’ গজ পরে গিয়ে আলোটি আবার ফুক্ করে জ্বলে উঠল। দক্ষিণ দিকে কিছুদূর যাওয়ার পর ভাই আবার জোরে এ- – ই – করে ডাক দিতেই আলোটি আবার নিভে গেল। অনেকক্ষণ পর আলোটি আবার জ্বলে উঠল। এক পর্যায়ে আলোটি দক্ষিণে যেতে যেতে একটি পড়ো ভিটার কাছে চলে গেল। ঐ ভিটায় বড় একটি জাম গাছ আছে। আলোটি এক লাফে জাম গাছের মাথায় উঠে নিভে গেল। জাম গাছটির উচ্চতা কম নয়, ত্রিশ চল্লিশ হাত হবে। আলোটি এক লাফে জাম গাছের মাথায় উঠায় আমরা আশ্চর্য হয়ে গাছের দিকেই তাকিয়ে আছি। অনেকক্ষণ আলো আর দেখা গেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর জাম গাছের মাথায় আলোটি আবার জ্বলে উঠল। কয়েকবার আলো জ্বলে উঠল আবার নিভে গেল। এভাবে আলো জ্বলা-নেভা করতে করতে হঠাৎ এক লাফে গাছের মাথা থেকে মাটিতে নেমে এলো। মাটিতে নেমে পশ্চিম দিকে কিছুদূর গিয়ে আবার নিভে গেল। অনেক দূরে গিয়ে আবার জ্বলে উঠল। এইভাবে কয়েকবার আলো জ্বলা নেভা করতে করতে প্রায় পাঁচশ’ গজ পশ্চিমে ফাঁকা মাঠের মাঝে কয়েক বিঘা পরিমাণ ছন ক্ষেতের মাঝ খানে মাঝারি ধরনের একটি কড়ই গাছের মাথায় উঠে গেল। কড়ই গাছের মাথায় উঠে আলো নিভে গেল এবং কিছুক্ষণ পর আবার জ্বলে উঠল। অনেকক্ষণ কড়ই গাছের মাথায় থাকার পর আলোটি এক লাফে জমিতে নেমে এলো।
এরপর উত্তর দিকে কিছুদূর গিয়ে ফাঁকা মাঠের মাঝখানে রাস্তার পাশে অনেক পুরানো একটি শেওড়া গাছের উপরে উঠে আলো নিভে গেল, এরপর অনেকক্ষণ শেওড়া গাছের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিন্তু আলো আর জ্বলল না।
ফুফুকে বললাম, এত বড় গাছের উপরে লাফ দিয়ে উঠল আবার লাফ দিয়ে নামল এটা কিসের আলো ফুফু?
ফুফু বলল, এটা ভূতের আলো।
আলোর অস্বাভাবিক চলাফেরা এবং লাফ দিয়ে গাছে উঠার লক্ষণ দেখে আমরাও ফুফুর কথাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছি।
পরদিন স্কুলে গিয়ে ঘটনাটি ক্লাসে শিক্ষকের কাছে বললাম। শিক্ষক এটাকে আলেয়ার আলো বলে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করল। আমি যখন শিক্ষককে প্রশ্ন করলাম, স্যার, আলেয়ার আলোই যদি হয়, তাহলে কি করে আলো এক লাফে ত্রিশ চল্লিশ হাত উপরে গাছের মাথায় উঠে আবার এক লাফে ত্রিশ চল্লিশ হাত নিচে জমিনে নেমে এসে আলো জ্বলতে জ্বলতে অন্য গাছে গিয়ে উঠে। কিছুক্ষণ পর সে গাছ থেকে নেমে অন্য দিকে চলতে থাকে। আলো জ্বলা অবস্থায় ডাক দিলে নিভে যায় আবার কিছুক্ষণ পরে জ্বলে উঠে, আবার ডাক দিলে আবার নিভে যায়। আলেয়ার আলো একদিকে যাবে বা বাতাসের অনুকুলে যাবে কিন্তু এ আলো যে উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম উপর-নিচ সব দিকে যাতায়াত করে। আলেয়ার আলো কি স্যার বাতাসের প্রতিকুলসহ সবদিকে যাতায়ত করতে পারে?
স্যার আমার এ কথার সদুত্তর দিতে পারল না। আমিও তাকে আর কোন প্রশ্ন করলাম না। তবে ঐ রহস্যেময় আলোর সঠিক উত্তর কি হতে পারে তা আজো কারো কাছেই জানা সম্ভব হয় নাই।
-ঃ সমাপ্ত ঃ-
Recent Comments