দগ্ধ হৃদয় (তৃতীয় র্পব)
ইসহাক আলী প্রামানীক
প্রায় এক বৎসর গত হয়েছে। একদিন সকাল বেলা ইনামুল তার পড়ার ঘরে বসে ভাবছিলো। এমন সময় হাসিনার গলার আওয়াজ শোনা গেল। সে ইনামুলের মাকে কি যেন বলছে, তখন ইনামুল কান খাড়া শুনতে পেল।
চাচী আম্মা ইনাম ভাই কোথায় ?
-জানিনা তো তা এতো সকালে ওকে কি দরকার, ইনামের মা বলেলো।
-চাচা মিয়া আমাকে ডাকতে পাঠালেন। উনি এলে একটু পাঠিয়ে দিবেন।
-তোমার আব্বার অসুখের এখন কেমন অবস্থা।
-আজ খুব বেশী অসুস্থ্য হয়েছে। আমি দেরী করতে পারছিনা। চাচী আম্মা ভাইজান কি পড়ার ঘরে আছেন ?
-আমিতো জানিনা। তবে তুমি দেখতে পারো।
-তখন হাসিনা দেরী না করে তাড়াতাড়ি ইনামের পড়ার ঘরে ছুটে গেল। ইনামুল তখন অংক করতে ছিল। হাসিনা ঘরে ঢুকেই তাকে দেখতে পেয়ে বলল, ভাইজান বই গুছিয়ে রেখে আমার সাথে চলুন। কারণ চাচা মিয়া এক্ষণি আপনাকে দেখা করতে বললেন।
-ঠিক আছে, তুমি যাও আমি আসছি।
হাসিনা চলে গেলে, ইনামুল বই গুছিয়ে রেখে দিল এবং গায়ে জামা পড়ে ঘর থেকে বেড় হয়ে গেল। হাসিনার বাড়ী এসে দেখে করিম সাহেব দাড়িয়ে আছে।
-চাচা মিয়া আপনি কি আমাকে ডেকেছেন?
-হ্যা ডেকেছি।
-কেন কি হয়েছে চাচা মিয়া।
-তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।
-কি কাজ করতে হবে ?
-তোমাকে ডাক্তারের বাড়ী যেতে হবে ?
-কেন বড় চাচার অসুখ কি কম হয় নি?
-না বাবা আজ আরো বেশী হয়েছে ॥
-ঠিক আছে চাচা এক্ষুণি যাচ্ছি।
-সাইকেল নিয়ে যাও, দেরী করনা। ডাক্তারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।
-না দেরী হবে না ॥ এই বলে ইনামুল দ্রুত বেড়িয়ে গেল।
ডাক্তারের বাড়ী দুরে না হলেও তবু দেড় মাইল যেতে হবে। থানা পর্যায় ছাড়া ভালো ডাক্তার নেই। গ্রামে-গঞ্জে দু-চারজন হাতুড়ে ডাক্তারই গ্রামের মানুষের শেষ ভরসা, নইলে টাঙ্গাঈলে মির্জাপুর মানুষের শেষ ভরসা।
-ইনামুল বেড় হয়ে আসার পথে হাসিনার বাবাকে এক পলক দেখে এসেছে। তার অবস্থা খুবই গুরুতর, শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় না আর টিকবেন। ডাক্তারের বাড়ীর কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলেন ডাক্তার কোথায় যেন যাচ্ছেন। তখন তাকে ডাকাডাকি করে যাত্রা থামিয়ে দিলেন।
ডাক্তার মুখ ফিরে দেখতে পেলেন ইনামুল সাইকেলে দ্রুত আসছে। ডাক্তারের কাছে এসে ইনামুল বলল, ডাক্তার কাকা মৌলভী সাহেবের অবস্থা খুবই শোচনীয় তাড়াতাড়ি চলুন।
-কোন্ মৌলভী সাহেব ?
-আজিজ মৌলভী সাহেব।
-ও-কেন আজ আবার কি হয়েছে ?
-তিনি আজ খুবই অসুস্থ্য, তাড়াতাড়ি চলুন। আমার সাইকেলে উঠুন।
-তবে সেদিন না বললে একটু সুস্থ্য হয়েছেন। তাইতো আমি নিশ্চিত বসে আছি। তাই আর খোঁজ নেইনি। কিন্তু আজ আবার হঠাৎ করে অসুখ বেড়ে গেলো এখন কি উপায় করা যায়।
-আপনি চলুন না ডাক্তার সাহেব। তাড়াতাড়ি চলুন।
-আচ্ছা দাড়াও আমি ব্যাগটা নিয়ে আসি।
-খুব তাড়াতাড়ি ব্যাগটা নিয়ে আসুন। ওদিকে আবার হয়ত কি না কি অবস্থা দাড়ায় কে জানে।
-একটু পর ডাক্তার সাহেব ব্যাগ হাতে করে বেড় হয়ে আসলো। তারপর তারা উভয়ে দ্রুত সাইকেলে চলে গেলো।
এদিকে ইনামুল যাওয়ার কয়েক মিনিট আগেই মৌলভী সাহেবের শ্বাস কষ্ট উঠেছে। প্রলাপ বকতে ছিল। হাসিনার মা অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল। চীৎকার করে কাঁদতে লাগলো। তাঁর চীৎকার শুনে, করিম সাহেবের চিত্ত্ব এমনিতে কেঁদে উঠল। সে দৌড়ে বড় ভাইয়ের কাছে গেলো। অবস্থা দেখে মনে হলো তার ভাই আর বাঁচবেন না। তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে আসতেছে। করিম সাহেব ডাকলেন ভাইজান, আমি করিম। এই বলে ভাইজানের হাত ধরে বললো ভাইজান কোন অপরাধ করে থাকলে মাপ করে দিবেন।
মৌলভী সাহেব চোখ খুলে বললেন তোরা আমার ভুল ত্র“টি ক্ষমা করে দিস, তোদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবে। তুই আমার ছেলেমেয়েদের প্রতি একটু খেয়াল করিস বাকী আল্লাহর ইচ্ছা, তবে তুই যতদিন বেচে থাকবি ততদিন আমার ছেলেমেয়েদের প্রতি খেয়াল রাখবি। যাতে ওরা সুস্থ্যভাবে জীবন যাপন করতে পারে, মেয়েটাকে দেখে শুনে একটা বিয়ের ব্যবস্থা করবি। তোর কাছে আমার শেষ মিনতি। তারপর তাঁর কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে আসলো আর কোন কথা বলতে পারলো না ॥
তৎক্ষণাৎ মৌলভী সাহেব করিমের হাত ছেড়ে দিয়েছে। করিম সাহেব তার মুখে একটু পানি দিলেন এবং কানে কানে কালেমা শোনালেন। মৌলভী সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না। ধীরে ধীরে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে গেল, চির দিনের মতো সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। পর জগতের যাত্রী দলে তিনি ভর্তি হলেন।
ইহজগতে কিছু নেই, আছে শুধু দুঃখ আর পাপে জড়াকীর্ণতা। যদিও সুখ আছে তাহা দুদিনের জন্য। ইহজগতে অর্থকড়ি যেই অধিকারিনী হোক না কেন, যতই গাড়ী-বাড়ী দালান কোটা থাকনা কেন সকলকেই একদিন সবকিছু ছেড়ে আপনজন আত্মীয় স্বজনকে বিসর্জন দিয়ে পর জগতে যেতে হবে। এটাই চিরাচড়িত নিয়ম; এর কোন অন্যথা নেই। সকলকেই সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ইহজগত ছেড়ে যেতে হবে কেউ নিজকে ধরে রাখতে পারবেনা এটাই বিধির বিধান। সেইরূপ আজ মৌলভী সাহেবের প্রাণ পাখী খাঁচা থেকে বেড়িয়ে চলে গেল, শুধু শূন্য খাঁচা পড়ে রইল। ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে আজ শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেল। তাদের মনে কতনা আবেগ আশা, আকাংখা ছিল তাহা পলকের মধ্যে ধুলিসাৎ হয়ে গেল।
তারপর ইনামুল দৌড়ে বাড়ীর ভিতর চলে গেল, সে দুর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনে যা মনে করেছিল ঘরে প্রবেশ করে তাই দেখলো। কেহ কেহ মৃত্যুর শিয়রে বসে অশ্র“ বিসর্জন করছে, কেহ অনুশোচনা করছে।
আকাশে তখন কোন মেঘ ছিল না সূর্য অস্ত যায়নি তবু সেদিন আমাবশ্যার ঘোর অন্ধকার নেমে ছিল এই মৌলভী সাহেবের বাড়ীতে ॥ চোখের অশ্র“তে সবাই যেন অন্ধকার দেখছে।
এই শোকের ভিতর আর্তনাত করে ডাক্তার সাহেব তাঁর বেদনা নিরশন করে চোখ মুছে “ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন।” বলে প্রস্থান করলেন। মৃত্যুকালে মৌলভী সাহেব কি বলতে চেয়েছিলেন, হাসিনার কথা তাহা কারো দৃষ্টিগোচর হলনা, বিষয়টি কেউ কোন ভাবে বুঝতে চেষ্টা করল না।
কয়েকদিন পর ইনামুল স্কুলের দিকে যাচ্ছে এমন সময় রাস্তার ধারে যে গাছের নীচে হাসিনা দাড়িয়ে অপেক্ষা করতো, আজ তাকে সেইখানেই দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। গাছটির সম্মুখেই মৌলভী সাহেবের সমাধি। হাসিনা সেই সমাধির দিকে তাকিয়ে আছে। তখন ইনাম নিকটে গিয়ে আর্ত কষ্টে বললো, তুমি আজ স্কুলে যাবে না।
কিন্তু কোন জবাব এলোনা, মনে হয় সে শুনতে পারেনি। তাই আবার ডাক দিলো, হাসিনা ও হাসিনা।
তারপরও কোন উত্তর এলোনা। তখন সে ভালো করে চেয়ে দেখে হাসিনার নয়ন দিয়ে অঝরে বারিবী ঝরছে।
হাসিনা যখন ছোট ছিল তখন পিতার কতনা আদরের দুলালী ছিল। কাজের সময় বাবাকে কতনা অত্যাচার করতো, কাজে বিঘ্র ঘটাতো। বাবা আদর দিয়ে তা সহ্য করে নিতো। এখন কার নিকট সেইসব অত্যাচার বা আবদার করবে, তার ঠিকানা জানা নেই। কখনও কেউ যদি কিছু করতো বা বলতো, তবে বাবাকেই নালিশ করতো এমন কি মায়ের বিরোদ্ধেও নালিশ করতে ছাড়তো না। কিন্তু তার বাবা আজ নেই হাসিনাদেরকে ছেড়ে ঘুমন্ত রাজ্যের বাসিন্দা হয়েছেন যেখানে হাসিনা বা পরিবারের কেহই সহজে যেতে পারবেনা। কারো বিরোদ্ধে কোন অভিযোগও জানাতে পারবে না। তাই হাসিনা এখানে দাড়িয়ে কাঁদছে। কারণ কোন অভিযোগ বা কোন আব্দার শোনার কোন উপায় নেই, তার বিরোদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ করারও কোন ব্যক্তি নেই। এসব চিন্তা করে হয়তো হাসিনা কেদেই চলেছে।
তাছাড়া সে এখন আর আগের মতো ছোটটি নেই। পনেরো বছরে পা দিয়েছে, তার হৃদয়ে বইছে পিতৃ ¯েœহ। সে পিতাকে অগাধ ভালোবাসতো কিন্তু বিধাতা সেই আদর সোহাগ, ভালোবাসা হঠাৎ করে ছিন্ন করে দিয়েছে।
তারপর ইনামুল হাসিনাকে ধাক্কা দিয়ে তার হুশ ফিরে আনলো এবং তাকে বুঝাতে লাগলো-হাসিনা কেঁদে কোন লাভ নেই তিনি চলে গেছেন। তুমি শোকর গোজারী করো যাতে তার আত্মা শান্তি পায় এবং জান্নাতবাসী হয়। এ জগতটা ক্ষণস্থায়ী আমরা কেউ চিরস্থায়ী বাসিন্দা নই। এ পৃথিবী ছেড়ে একদিন সকলকেই বিদায় নিতে হবে। কেউ চিরদিনের জন্য থাকতে পারবে না। এসব বিধির বিরম্বনা। অদৃষ্টের লিখন, কেউ খন্ডাতে পারবে না; আর কান্না কাটি করো না, খোদার নিকট প্রার্থনা কর, সে জেন জান্নাতবাসী হয়।
(চলবে)
ছবি ঃ গুগল
প্রথম পর্ব পড়ার জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন
Recent Comments