রোস্তম ফকির (পর্ব -০২)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
রোস্তম ফকিরের চিল্লাচিল্লিশুনে বাঁধের উপরে যারা শুয়ে ছিল তাদের অনেকেই ঘুম থেকে উঠে এলো। কিন্তু চেয়ারম্যান ও রোস্তম ফকিরের বচসা ও গলাধাক্কা সচক্ষে দেখার পরও কেউ কোন প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। এমন কি তারা কেউ বাঁধের নিচেও নামল না। চেয়ারম্যান মানুষ হিসেবে খুবই খারাপ প্রকৃতির। এসব কাজে যে প্রতিবাদ করতে যাবে তাকেই ধরে মারধর করবে অথবা রিলিফের সমস্ত গম সরিয়ে ফেলে প্রতিবাদকারীদের নামে উল্টো ডাকাতি কেস দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিবে।
রোস্তম ফকির ঘাড় ধাক্কা খেয়ে বাঁধের উপরে উঠে উত্তর দিকে কিছুদূর গিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ল। নিচের দিকে মুখ করে নিরবে চোখের পানি ছেড়ে কাঁদতে লাগল। তার এই অসহায় অবস্থায় কেউ তার কাছে এলো না। বাঁধের লোকজন সব দেখার পরেও না দেখার ভান করে যে যার জায়গায় বসে থাকল। চেয়ারম্যানের ভয়ে কেউ মুখটি পর্যন্ত খুলল না।
রোস্তম ফকিরকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়ার পর চেয়ারম্যান তার লোকদের দ্রুত গম বোঝাই করে নৌকা ছেড়ে দিতে বলল। নৌকা বোঝাই করার পর চেয়ারম্যান নিজেও ঐ নৌকায় উঠে চলে গেলেন।
চেয়ারম্যান চলে যাওয়ার পর কয়েকজন এসে রোস্তম ফকিরকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল। কেউ কেউ তাকে একাজ করার জন্য ভাল বললেও অনেকে তিরস্কার করল। একজন বলল, চেয়ারম্যান একটা সন্ত্রাসী মানুষ, এ এলাকার বড় বড় মাইনষেরাই তার মুখের উপর কথা কয় না, আপনে কোন আক্কেলে তার সাথে পাল্লা ধরতে গ্যাছেন? আপনের সাহসের তারিফ না কইরা পারি না! রোস্তম ফকির তাদের এসব কথার কোন জবাব দিলো না। যেমন বসে ছিলো তেমনি বসে রইলো।
সকাল বেলা সবার কানে কানে রোস্তম ফকিরের দুঃসাহসের কাহিনী ছড়িয়ে গেল। প্রায় লোকই রোস্তম ফকিরের রাতের ঘটনা শুনে মনে মনে খুব খুশি হলো কিন্তু মুখে কেউ কিছুই বলল না। তবে অনেকেই রোস্তম ফকিরকে সাবধান করে দিল। আগামীতে যেন চেয়ারম্যানের সাথে আর কখনও এরকম ঘটনা না করে। অনেকে ভয় দেখালো। আরেকবার এরকম করলে চেয়ারম্যান আপনাকে জীবন্ত কবর দিয়া ফেলবে, সাবধান! ভুলেও আর কখনও একাজ করবেন না।
বেলা দশটার দিকে চেয়ারম্যান তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে রিলিফ বিতরণের জন্য এলেন। পূর্ব থেকেই তৈরী করা লিস্ট দেখে নাম ডেকে ডেকে গম বিতরণ করছেন। যারা প্রকৃতপক্ষে রিলিফ পাওয়ার উপযুক্ত তাদের অনেকেই পেল না। আবার যারা পেল তাদের অনেকেই পরিমাণে কম পেল। যাদের রিলিফ পাওয়ার কথা নয় তারা গরীব মানুষের চেয়ে অনেক বেশি পেল। রিলিফ যারা বেশি পেয়েছে তাদের চেয়েও বেশি পেল চেয়ারম্যানের চামচারা।
লিস্টে রোস্তম ফকিরের নামও ছিল। তার নাম ডাকার পর রোস্তম ফকির উপস্থিত ছিল না। চেয়ারম্যান কাছেই চেয়ারে বসে ছিলেন। রোস্তম ফকিরের নাম উচ্চারণ করতেই ডাক দিয়ে বললেন, এই– ঐ নামের গম বাদ রাখ। আগামীতে ওর নাম লিস্ট থাইকা বাদ দিয়া দিবি।
যে ব্যাক্তি লিস্ট নিয়ে বসে ছিল তার নাম বিলাল। সে বলল, চেয়ারম্যান সাব, ও ফকির মানুষ, ওর নাম বাদ দেওয়া কি ঠিক হইবো?
এ কথা শোনার পর চেয়ারম্যান ক্ষেপে গেলেন। দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, এই বিলাল এই–, তোর ফকিরের প্রতি যদি এতো মায়া লাগে, তোর বাড়ি থাইকা গম দিয়া দিস। এখান থাইকা একটা গমও দিবার পারবি না। বলেই মেজাজ গরম করে বলল, এই বিলাল এই — , লিস্টটা আমার হাতে দে। লিস্ট হাতে নিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে উঠল, তুই এখান থাইকা উইঠা যা। ভাগ তুই। এই এলাকায় আর থাকবি না। যা কইতাছি। সোজা বাড়ি চইলা যা। আমার সামনে আর এক মুহুর্তও থাকবি না। বেহায়া পোলাপান, আমার মুখের উপর কথা কস। তর সাহস তো কম না। আমি তর চায়া কম বুঝি রে? বেয়াদ্দপ কোনহানকার। ভালোবাসি বইলা সুযোগ পায়া আস্তে আস্তে মাথায় উইঠা গ্যাছোস না- – ?
বিলাল মুখটি কালো করে চেয়ারম্যানের হাতে লিস্ট দিয়ে চুপচাপ উঠে চলে গেল। না গেলে হয়তো চেয়ারম্যান চর-থাপ্পর দিতে পারে। চর-থপ্পরের ভয়ে সে আর কোন কথাই বলল না। এই ঘটনা দেখার পরে উপস্থিত যারা ছিল তারা রোস্তম ফকিরের জন্য সুপারিশ করা তো দূরের কথা রোস্তম নামের অন্য কেউ থাকলেও তার নামও উচ্চারণ করার সাহস পেল না। রোস্তম ফকির নিজেও রিলিফ বিতরণ এলাকার আশেপাশে এলো না। কোথায় আছে তাও কেউ বলতে পারল না। ফকিরের রিলিফ বন্ধ করার ব্যাপারটি মনে মনে কোন লোকই সমর্থন করল না। তবে মুখ ফুটে বলার সাহসও পেল না।
সারাদিন কেউ রোস্তম ফকিরের দেখা পেল না। সন্ধার পূর্বমূহুর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেই দালান ঘর থেকে আধা মাইল উত্তরে পাওয়া গেল। রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে বসে পূর্ব দিকে মুখ করে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। লাঠির গোরার অংশ মাটিতে ঠেকিয়ে উপরের অংশ নিজের ঘাড়ে হেলান দিয়ে তার উপরে হাত দু’টি রেখে কি যেন ভাবছে। মুখ শুকিয়ে গেছে, হয়তো সারা দিন খাওয়া হয়নি। রোস্তম ফকিরের সমবয়সী আকবার আলী কাছে এসে ডান পার্শ্বে বসে বলল, রোস্তম ভাই, সারা দিন কই ছিলেন?
রোস্তম ফকির জবাব দিল, ঐ উত্তর দিকে।
— রিলিফ আনতে যান নাই?
— না।
— কেন?
— ঐ চোরের দেয়া রিলিফ আমি নিমু না।
— সারা দিন খাইছেন কিছু?
— না।
— ভিক্ষায় গেছিলেন?
— না।
— না খায়া কয় দিন থাকবেন?
— আল্লায় যে কয় দিন রাখে।
— রাইতে খাইবেন কি? ঘরে খাওন আছে?
— না।
— তাইলে এক কাজ করেন, সোজা আমার ডেরায় চইলা যান, আমি কয়া দিতেছি, আমার বউ চারটা গম দিলে ভাইজা খায়া নিয়েন। বুড়া বয়সে না খায়া থাকা ঠিক হইব না।
— গম কই পাইলেন?
— চেয়ারম্যানের কাছ থিকা রিলিফ আনছি।
— ঐ চোরের দেয়া রিলিফের গম আমি খামু না।
রোস্তম ফকিরের এরকম কথায় লোকটি খুবই আশ্চার্য হলো। সারা দিন না খেয়ে আছে, ক্ষুধায় মুখ শুকিয়ে গেছে, তারপরেও চেয়ারম্যানের উপর থেকে তার জেদ কমছে না। বৃদ্ধ বয়সে চাল চুলোহীন ফকিরের প্রতিবাদী কণ্ঠ তার কাছে ভাল লাগলেও, না খেয়ে প্রতিবাদ করাটা ভাল লাগল না। তার এরকম জেদ আর কখনও দেখেনি। এর আগে ভিক্ষার জন্য মানুষ কত তাকে তিরস্কার করেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, প্রতিউত্তুর করতেও কখনও দেখা যায়নি। বৃদ্ধ হলে মানুষের মেজাজ খিটখিটে হয়। কিন্তু চাল চুলোহীন অসহায় বৃদ্ধ রোস্তম ফকিরের খিটখিটে মেজাজ নয় তার সিংহের মত দেমাগ দেখে আশ্চার্যই হয়ে গেল। এরকম মানুষ আর একটিও তার জীবনে চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ে না। অসহায় অবস্থায় না খেয়ে মরে যাবে তবুও চেয়ারম্যানের কাছে হার মানবে না। এ যেন অন্যায় প্রতিবাদের চরম প্রতিশোধ নেয়ার জেদ।
আগে রোস্তম ফকিরকে দেখলে কেউই তার দিকে তেমন একটা তাকাতো না। গতরাতের ঘটনার পর থেকে ফকির যার সামনেই পড়ছে সেই একবার তাকে ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখছে।
রোস্তম ফকির আর আকবার আলীর কথাপোকথনের সময় কৌতুলবশতঃ অনেকেই সেখানে জড়ো হয়েছিল। কেউ কেউ বলল, রোস্তম ভাই, আপনি চেয়ারম্যানের কাছে যায়া মাফ চান। তাইলে আপনারে গম দিয়া দিব।
রোস্তম ফকির পিছন ফিরে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বলল, মইরা গেলেও আমি চেয়াম্যানের কাছে যায়া মাফও চামু না, ঐ চোরের গমও নিমু না।
পাশান আলী নামের আরেক জন বলল, রোস্তম ভাই, আপনে চেয়ারম্যানরে বার বার চোর চোর কইতেছেন ক্যান? এটা হুনলে তো চেয়ারম্যান আপনারে বাইন্ধা পিটাইবো।
রোস্তম বলল, পিটানোর আর বাকী রাখছে কি? রাইতে আমরে পিটাইছে না?
নুরুন্নবী বলল, রাইতে তো পিটাইছে মাইরা ফালায় নাই। এবার পিটাইয়া মাইরাই ফালাইবো। আচ্ছা আচ্ছা মাইনষে হের সাথে পাল্লা ধরে না। আর আপনি ফকির হয়া পাল্লা ধরবার গ্যাছেন। আপনার আসলে আক্কেল নাই। বুড়া হইছেন তো হুস হারা হইছেন।
নুরুন্নবীর কথায় রোস্তম ফকির দ্বিগুণ চটে গেল, লাঠি ঘাড় থেকে নামিয়ে ডান হাতে নিয়ে বলে উঠল, এই হারামজাদা! তোরে উপদেশ দিবার কইছি। আমারে তোরা পাগল পাইছস — না- – হ? যা হারামজাদা, আমি আর এইহানে থাকুম না। বলেই উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
লোকটি আবার বলল, থাকবেন কেমনে? নিজে খান ভিক্ষা কইরা, আবার চেয়ারম্যানরে কন চোর।
এ কথা শুনে রোস্তম ফকির আরো উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে হারামজাদা– রোস্তম ভিক্ষা কইরা খাইলেও জীবনে কোন দিন চুরি কইরা খায় নাই। শালা চোরের দল, চেয়ারম্যানের সাফাই গাইতে আইছস আমার কাছে। বলেই সে উত্তর দিকে হন হন করে চলে গেল।
তার চলে যাওয়ার ভাব দেখে অনেকেই হো হো করে হেসে উঠল। আবার অনেকে তার জন্যে দুঃখ করল। মধ্য বয়সী হযরত আলী ছেলে-ছোকরাদের ধমক দিয়ে বলল, এ– ই- – তোরা ফকিররে ক্ষ্যাপাইতাছোস ক্যান হা- – হ্-। একে তো ফকির তার উপর আধাপাগোল মানূষ, কখন কি কয় হুস নাই, একটুতেই চেইতা যায়। তারে উল্টাপাল্টা কথা কয়া আরো চেতাইতেছোস। বেশি চেতাইলে আবার না রাগে দুঃখে হার্ঠফেল কইরা মরে! লোকটির ধমকের পরে আর কেউ কোন কথা বলল না। সবাই চুপচাপ যে যার জায়গায় চলে গেল।
(— চলবে —)
Recent Comments