মরিচ খোর (রম্য)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। ইত্তেফাকের পূর্বপাশের হোটেলে বসে দুপুরে ভাত খাচ্ছি। যদিও দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম কিন্তু সময়টা দুপুর ছিল না তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। হোটেলে তেমন ভিড়বাট্টা নেই। মাঝখানের ফাঁকা একটা টেবিলে বসে খাচ্ছি। খাওয়া শুরুর পরপরই আমার টেবিলের সামনের চেয়ারে মাঝ বয়সি এক ভদ্রলোক এসে বসলেন। পায়জামা পাঞ্জাবীর সাথে দলীয় পোষাক পরেছেন। পাবনা, সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। তার পোষাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হলো খুব বড় না হলেও ছোট খাটো রাজনৈতিক নেতা হবেন।
হাতমুখ ধুয়ে এসে আরাম করে বসলেন। আমি মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। তিনিও নলা মাছ দিয়ে ভাতের অর্ডার দিলেন। আমার তখন অর্ধেক খাওয়া হয়েছে। বয় ভাত তরকারী দিয়ে গেলে উনি খাওয়া শুরু করলেন। ভদ্রলোকের খাওয়া দেখে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। টেবিলে বাটি ভরা কাঁচা মরিচ ছিল। বাটি থেকে একটা করে কাঁচা মরিচ নিচ্ছেন আর ভাতের সাথে ডলে ডলে প্রতি লোকমায় একটা করে খাচ্ছেন।
উনার মজা করে মরিচ খাওয়া দেখে কৌতুহল বশতঃ বললাম, বড় ভাই, মরিচগুলো মনে হয় ঝাল কম?
আমার কথা শুনে উনি আরেকটা মরিচ ডলতে ডলতে বললেন, ঝাল নাই দেইখাই তো লোকমায় লোকমায় খাইতে পারতেছি, নইলে কি আর এত মরিচ লাগে?
তার কথা শুনে আমারও মরিচ খাওয়ার খুব শখ হলো। ঝাল যদি কম হয় আর খেতে যদি মজা লাগে, তাহলে আর খেতে অসুবিধা কি? উনি পনেরো বিশটা খেলে আমার অন্তত একটা তো খাওয়া দরকার? তার মত করেই ভাতের সাথে মরিচ ডলে ভাতসহ মরিচ মুখে দিয়ে চিবাতে লাগলাম। কিন্তু দুই তিন চিবানি দিয়েই আমার মুখ হা হয়ে গেল, হা করা মুখ আর চাপাতে পারছি না। মরিচের ঝালের চোটে পুরো মুখ জ্বলতে লাগল। কুলাতে না পেরে মুখটা বোয়াল মাছের মত হা করে শুধু হু হা- – হু হা- – করতে লাগলাম। চোখ দিয়ে টপ টপ করে কান্না ছাড়াই জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। তরকারী বাদ দিয়ে খালি শুকনা ভাত মুখে দিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। তারপরেও ঝাল যেতে চায় না। ভদ্রলোক যতটা মরিচ মজা করে খেলেন আমি মাত্র অর্ধেক মরিচ খেয়েই ঝালের চোটে তত ঢোক পানি গিলে খেলাম। তারপরেও মুখ, পেট জ্বলতে লাগল।
দুই চোখের পানি নিয়ে হু হা হু হা করতে করতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্র লোক আমি ভাত খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছি দেখে খাওয়ার মাঝেই পাতের দিক থেকে মুখ তুলে তাকালেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আশ্চার্য হয়ে বললেন, কি রে ভাই, একটু আগেই তো আপনারে ভাল দেখলাম, হঠাৎ করে কান্দা শুরু করলেন ক্যা! আপনার মনে আবার কি দুঃখ দেখা দিল?
তার কথা শুনে পিত্তি জ্বলে উঠল। মনে মনে গালি দিয়ে বললাম, আপনার মরিচ খাওয়ার চৌদ্দ গুষ্ঠি কিলাই। আপনার কথা বিশ্বাস করেই তো দুই চোখের পানি ছেড়ে নিরবে কাঁদতে হচ্ছে।
মনে মনে যত গালিই দেয় না কেন মুখে হু– হা– হু– হা– ছাড়া কোন কথা বললাম না। ভদ্রলোকের কথার উত্তরে আমি কোন কথা বলছি না দেখে, নিচের দিকে মুখ করে তিনি আবার আস্ত মরিচ ডলে ডলে খেতে লাগলেন।
আমার পুরো ভাত খাওয়া আর হলো না। পাতে ভাত রেখেই চেয়ার থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। টেবিলে এসে দেখি ভদ্রলোক বিশ পঁচিশটি মরিচসহ পুরো দুই প্লেট ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। তার ভাব দেখে মনে হলো ভাত তরকারীর মত মরিচও একটা পেট ভরে খাওয়ার মত খাদ্য। অনেক লোককেই কাঁচা মরিচ খেতে দেখেছি, কিন্তু এই লোকের মত এত মরিচ খোর আর জীবনে দেখি নাই।
টেবিলে বসে ঘনঘন পানি খেতে খেতে ভাবতে লাগলাম, যে লোক এত ঝাল মরিচ অনায়াসে গিলতে পারেন, সে লোক যদি নেতাগীরি করার সময় বক্তৃতায় এর ছিটেফোটাও উদগীরণ করেন, তাহলেও বিপক্ষ দল কথার ঝালের চোটে কুপোকাত হয়ে যাবে। কিন্তু উনি বাস্তবে কি রকম নেতা সেটা জানার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে তার মরিচ খাওয়ার কথা মনে হলে এখনও আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।
Recent Comments