ভোগ না করেই ভোগান্তি
পবন সরকার
সন্ধ্যার সময় নামকরা এক মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খেতে গিয়েছিলাম। অনেক পদের মিষ্টির মাঝে গামলায় দুধে ভিজানো কিছু মিষ্টি ছিল। বয়কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম গামলা থেকে একটা মিষ্টি দেয়ার জন্য। ব্য় ছোট একটা বাটিতে ঘন দুধের ভিতর একটি মিষ্টি দিয়ে গেল। চামচ দিয়ে কেটে খেতে খুব মজাই লাগল।
খাওয়া শেষে বয়কে খুঁজে পেলাম না। কোথায় যেন গেছে। বয়ের অনুপস্থিতে বিল দিতে গেলে ম্যানেজার জিজ্ঞেস করল, কী খেয়েছেন?
আমি বললাম, ভাই, মিষ্টির নাম তো জানিনা, তবে চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা দুধে ভিজানো, চামচ দিয়ে কেটে খেতে বেশ মজা লাগল।
ম্যানেজার হাসি দিয়ে বলল, চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা তো দুই ধরনের মিষ্টি আছে, একটা সরভোগ আরেকটা মালাইভোগ, আপনি কোনটা খেয়েছেন?
হাসি দিয়ে বললাম, বয় কোনটা দিয়েছে আর আমি কোনটা খেয়েছি তা তো বলতে পারছি না, তবে দু’টার মধ্যে দামের কি কোন পার্থক্য আছে?
ম্যানেজার বলল, হ্যাঁ আছে, একটা ৫৫ টাকা পিস আরেকটা ৫০ টাকা পিস।
দামের হেরফের শুনে বললাম, তাহলে বয়কে ডাকেন, সেই বলতে পারবে আমাকে কোনটা দিয়েছে।
ম্যানেজার বলল, বয় তো মালিকের বাসায় চলে গেছে, আসতে দেরি হবে।
বয় আসতে দেরি হবে শুনে বললাম, তাহলে আপনি আপনার বিবেক অনুযায়ী দাম নিন, তবুও বয় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবো না।
ম্যানেজারের বিবেকের উপরে মিষ্টির দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়ায় তিনি তার বিবিককে সর্বোচ্চ ধাপে রেখে ৫৫ টাকা বিল নিল। ম্যানেজারের চাহিদা মত বিল দিয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম। মালিবাগ মোরে রিক্সা থেকে নেমেই দেখি সেই মিষ্টির দোকানের বয় দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা দূরে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, কিরে মিষ্টি খেতে দিয়ে কই পালিয়েছিলি?
বয় কাছে এসে বলল, স্যার পলাই নাই, মালিকের বাসায় গেছিলাম। বলেই বলল, আপনি মিষ্টির দাম কত দিছেন?
বললাম, ৫৫ টাকা।
আমার কথা শুনে আশ্চার্য হয়ে বলল, কন কি! এত দিছেন ক্যান?
আমি বললাম, আমাকে নাকি তুই সরভোগ না মালাই ভোগ দিয়েছিস এইজন্য এত টাকা নিয়েছে।
আমার কথা শুনে ছেলেটি হাত নাড়িয়ে মাথা দুলিয়ে বলল, আপনাকে তো কোন ভোগই দেই নাই। আপনারে হুদা রস মালাইয়ের বড় একটা পিস দিছি, যার দাম ২৫ ট্যাকা।
আমি ওর কথা শুনে আহাম্মকের মত চেয়ে রইলাম। আমার চেয়ে থাকা দেখে বলল, স্যার আমার সাথে আইসেন বাকি টাকা নিয়া যান।
মনে মনে ভাবলাম ত্রিশ টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে পুরানা পল্টনে যাওয়া আসায় ৬০ টাকা খরচ হবে, যত টাকা লাভ হবে তার চেয়ে দ্বিগুণ লোকসান, লোকসানের দিকে তাকিয়ে ফিরে যাওয়ার চিন্তা ছেড়ে দিলাম। তবে ছেলেটার সততা দেখে মুগ্ধ হলাম। খুশি হয়ে বললাম, আমি আর ফিরে যেতে পারবো না তার চেয়ে তুই ম্যানেজারের কাছ থেকে ত্রিশ টাকা নিয়ে নিস। আমি তোকেই বকশিশ হিসাবে ত্রিশ টাকা দিয়ে গেলাম।
ছেলেটি অসহায়ের মত মুখটা কালো করে বলল, স্যার– ম্যানেজার তো আমাকে ঐ ট্যাকা দিব না, চাইলে উল্টা আরো ধমক দিব, তার চেয়ে আপনিই টাকাগুলা নিয়া যান।
অল্প বয়সি ছেলেটির সততা ও অসহায়ত্বের ভাব দেখে পকেট থেকে দশটাকা বের করে ছেলেটির হাতে দিয়ে বললাম, ম্যানেজার যদি ট্যাকা না দেয় না দিবে তোরে এই দশ টাকা খেতে দিলাম।
আমার টাকা দেওয়া দেখে ছেলেটি আশ্চার্য হলে বলল, স্যার করেন কি! এমনিতেই আপনি ত্রিশ ট্যাকা গর্চা খাইছেন তারোপরে আরো দশ ট্যাকা দিতেছেন। না স্যার আমি এই ট্যাকা নিমু না। বলেই টাকা দশটি আমার হাতে দিয়ে দৌড়ে বাসে উঠে চলে গেল। আমি একপলকে অনেকক্ষণ বাসটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম, ম্যানেজারের মধ্যে সততা না থাকলেও খেটে খাওয়া হতদরিদ্র এই ছোট ছেলেটার মধ্যে সততা আছে।
Recent Comments