দগ্ধ হৃদয় (ষষ্ঠ র্পব)

ইসহাক আলী প্রামানীক

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কালো আধারে সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেছে। হাসিনা তার বাইরের কাজ শেষ করে ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে নিজ কামড়ায় চুপচাপ বসে আছে। মনে হয় সে তার দুর্ভাগ্যের কথাই ভাবছিল। তার মনে কত না আশা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ঠুনকো কাচের মত ভেঙ্গ চুরমার হল, তার সব আশা। অল্প বয়সে পিতার মৃত্যুর অনুতাপ তাকে নিরবে সহ্য করতে হচ্ছে। সে এখন সাবালিকা হতে চলেছে। অর্থাৎ পঞ্চদশ পার হয়ে সে ষোড়শী যুবতী হতে চলেছে। তা ভবিষ্যত কিভাবে অতিবাহিত হবে। এতোসব আজে-বাজে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছে। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ হলো, কিন্তু হাসিনার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ইনামুল দরজা দিয়ে ঢুকে দেখতে পারলো হাসিনার মা কি যেন একটা কাজ করছে। কিন্তু দরজায় শব্দ হওয়ায় সে মাথা ঘুরিয়ে দেখল, ইনামুল ঘরে ঢুকছে।
-কেমন আছেন চাচী আম্মা ?
-হা বাবা ভালো আছি, তুমি ভালো আছো তো বাবা?
-হা চাচী আমরা খোদার মর্জি ভালো আছি॥
-তা কবে এসেছো বাবা ?
-গত রাত্রে। তা হাসিনাকে তো দেখছিনা চাচী আম্মা?
-ও বোধ হয় ওর কামড়ায় বসে আছে। যাও বাবা ওর সাথে কথা বল গিয়ে। ও বড় ভেঙ্গে পড়েছে।
-ইনামুল ভিতর দরজা দিয়ে হাসিনার কামড়ায় প্রবেশ করলো।
হাসিনার মা আর ইনামুলের কথা সে শুনে দরজার দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। হাসিনা নিজেকে সামাল করে দাড়িয়ে বললেন, আসুন বসুন ভাই।
ইনামুল তার পাশে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। হাসিনা ইনামুলকে লক্ষ করে বললো, তা ভাই কেমন আছেন ?
-কেমন আর থাকবো। তা যেমন দেখতে পাচ্ছো তেমনই আছি।
-তার মানে ?
-আরে শরীর ভালো না থাকলে কি তোমাদের এখানে আসতে পারি ॥
-তা কাল না রাতে এসেছেন ? দিনে তো একবারো আপনার ছায়া দেখলাম না॥
-দেখবে কোথা থেকে ॥ তোমরা নাকি এখন বাড়ীর বাইরেই যাওনা ॥ তা এখবরটা শুনলে কোথা থেকে ?
-ঠিক বলেছেন ভাই॥ শুধু বাইরে কেন ? অন্য লোকের ছায়া দেখতেও নিষেধ। তথাপিও আমি আপনাদের বাড়ী সর্বদা যাই।
-আচ্ছা ! তবে যে আমি এসেছি ॥ আমার ছায়া দেখলে যে তুমি?
-আপনি কি অন্য লোক যে, আপনার ছায়া মারাতে- নিষেধ আছে।
-তা আজ কখন গিয়েছিলে আমাদের বাড়ী ?
-দুপুরে আপনি মনে হয় বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন।
-সম্ভবতঃ তাই হবে?
-আচ্ছা আপনি বিয়ে করবেন না?
-না -করব না?
-কেন করবেন না ?
-মনের মতো মেয়ে না পেলে কাকে বিয়ে করব॥
-তা মনের মতো মেয়েটি দেখতে কেমন হবে?
-শুধু দেখতে ভালো হলেই তো তাকে ভালো বলা চলেনা। তার আর কিছু দেখতে হবে জানতে হবে?
-তোমার বুঝে কাজ নেই।
-একটু খুলে বলো না হেয়ালী কর কেন?
-ইনামুল একটু ভেবে জবাব দিল :
আরে মনে কর, সুচরিত্রা, ভালো স্বভাব আদব কায়দা ভালো কাজকর্ম সুন্দর অতীব ন¤্র ব্যবহার ইত্যাদি যে থাকতে হবে তার। তাছাড়া স্বামী ভক্তা হতে হবে তাকে। যে সর্বদা আমাকে সুখে দুঃখে শান্তনা ও সুপরামর্শ দেয়ার অধিকারী হবে আমি তাকেই যে বিবাহ করব বুঝলে?
তখন হাসিনা হেসে বলল তাই নাকি, তবে একটা উদাহরণ দেন দেখি সে কার মত হবে?
কার মত বলি ? তবে আছে,
-আপনি কি কোথাও মেয়ে দেখেছেন ? দেখলে বলেন না। হাসিনা একটু বিমর্ষ আকার ধারণ করল? ইনামুলের সে দৃশ্যটি চোখে পড়লো।
-আরে আমি দেখেছি বৈকি ।
ইনামুল একটু ইতস্ত করতে লাগলো কোথাকার কথা বলবে সে। আসলে সেতো কোন মেয়ে দেখেনাই, মনগড়া ভাবে কথা বলেছে।
সেতো হাসিনাকেই পছন্দ করে। আরে হাদারাম মেয়ে কথার ভাবভঙ্গি দেখেও কিছুই বোঝেনা দেখছি।
আর অন্য কোন মেয়েকে সে দেখেওনি পছন্দও করে না, তাহলে কি বলবে এখন।
-কি ব্যাপার, ভাই বলেন না চুপ করে রইলেন যে, আমাদেরকে বলবেন না বুঝি? একটা মেয়ে বিষয়ে বলতে আপনার এতো আপত্তি কেন?
-আজ না আর একদিন শুনবে?
-না হলে আজই নইলে আর নয়। কারণ আমি একজন মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়ে বিষয়ে প্রতিদিন শুনতে চাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু আজকে ইচ্ছা হয়েছে তাই শুনতে চেয়েছি। ঠিক আছে আমার আর শোনার দরকার নেই বলে অভিমান মুখ ঘুরিয়ে নিল সে।
-ইনামুল বুঝতে পারল তাকে আজই কিছু একটা বলতেই হবে। না বললে সে আর কথা বলবেনা। সে ভাবতে লাগলো ছোট থেকে হাসিনাকে সে একান্ত ভাবে ভালো বাসে। সে কখনও অন্য মেয়ের কথা ভাবেনি। তাই হাসিনাকে নিয়েই সে উপমা দাড় করিয়েছে কিন্তু সে বোঝেনি। এখন যদি খুলে বলি তাহলে যদি সে ধীক্কার দিয়ে কিংবা লজ্জায় চলে যায়। তাই ইতস্তর করতে লাগলো। তারপর ইনামুল মাথা তুলে হাসিনার দিকে চেয়ে দেখলো, হাসিনা যেন লজ্জা পেল, মনে কর তোমার মতই।
-উঃ ঠিক হলোনা, মনে হয় মিথ্যা বললেন।
-আরে পাগলী যে সব গুণের কথা বললাম, সে সব যে তোমার মধ্যে আছে।
-ঠিক বলছেন তো !
হ্যা ঠিকই বলছি। তাকে যে আমি ছোট বেলা থেকে ভালবাসি। সে যে তোমার মতই।
-ধ্যাৎ ওসব কি আজে বাজে কথা বলছেন। তা বলেন তো তার নাম কি?
-অবিকল হাসিনার মত। তোমার মত দেখতে, টানাটানা চোখ, কালো কাজল ভূরু, রাঙা দুটি ঠোঁট, জবা ফুলের মত মুখটা লাল, কথায় যেন মিষ্টি ভরা হাসিতে যেন মুক্তা ঝরে, তাই তাকে বলি হৃদয়ের বুলবুলি পাখী।
-আচ্ছা কোথায় বাড়ী তার ?
-তার বাড়ীতো বেশী দুরে নয়। নিকটেই তার বাড়ী চোখ তুলে দেখলেই তাকে দেখা যায়।
-আমার তো স্বরণে পড়ছে না।
-একটু চিন্তা করে বলতো দেখি সে কে?
তাকে তোমার পছন্দ হয়েছে কি-না?
কিন্তু হাসিনা জবাব না দিয়ে ইনামুলের দিকে তাকিয়ে আছে। এবার ইনামুল তার হাতটা হাসিনার থুতনীতে লাগিয়ে বলে উঠল এইতো সে মেয়ে ॥
এবার হাসিনা লজ্জা পেলো। সত্যিতো এ গ্রামেতো বুলবুলি নামে কোন মেয়ে নেই। আমাকে কেউ কেউ চেহারা দেখে বুলবুলী বলে ডাকে। তখন মাথা তুলে ইনামের দিকে চেয়ে দেখলো, দেখে ইনামুল মিষ্টি মিষ্টি হাসছে। চোখাচুখি হতেই ইনামুল বললো কেমন হয়েছে। হাসিনা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো, তখন ইনামুল বুঝতে পারলো যে ঔষধ কাজে লেগেছে। তাই নিজকে সংযত করে ইনামুল বলে ঊঠল এবার চিন্তে পরেছে ? মেয়েটি কে?
লজ্জায় হাসিনা চলে যাবার জন্য দাড়িয়ে পড়ল।
ইনামুল হাত টেনে ধরে বললো না বলে যেতে হবে। নইলে যেতে দেব না। বলো সে কে ?
ঝাকুনি মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে, দুই হাত দিয়ে ইনামকে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল, যান আপনি বড় ইয়ে॥ এই বলে সে দৌড় দিল॥ হাসিনার মা দেখে হেসে উঠে বললো এই কি হয়েছে তোদের।
-না কিছু হয়নি মা।
-ইনামুল ধারণা করল হাসিনা হয়তো আমার কাছে এমন কথা আসা করে নাই। তাই লজ্জায় সে চলে গেল। হয়তো আর কোনদিন সে আর সামনেই আসবে না। তাই আর এখানে বসে থেকে লাভ কি, অতএব চলে যাই। তবে মনের কথাটি তো বলতে পেরেছি এই যথেষ্ট। তাই ইনামুল উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু কে যেন ঘার চেপে ধরেছে উঠতে পারলনা। ইনামুল আবার বসে পড়লো। একটু পরেই পিছনে ঝাকুনি দিয়ে বলে উঠল কি যাওয়া হচ্ছিল যে বড়ো। হাসিনা আবার এসে পিছনে দাড়িয়েছে কখন ইনামুল তা বুঝতে পারেনি।
-তুমি যে যেতে বললে তখন ?
ওটাতো রস করে এমনি বলেছি, পরে মনে হলো যদি চলে যায় তাই তাড়াতাড়ি এসে পিছনে দাড়িয়েছি।
-তখন তুমি কিছু না বলেই যে চলে গেলে। আমাকে কিছুই বললে না যে ॥
-চুপ করেন তো আরো বলতে হবে নাকি ?
-তাই বুঝি !
-তাই নাতো কি? কথা যেন সত্যি হয় ॥
-নিশ্চয় খোদা সহায় হবেন ॥ তুমি দেখ।
-খোদা তুমি আমাদের ইচ্ছা পূরণ করো ॥
-আচ্ছা এখন আমি যাই। রাত অনেক হলো ॥
-আজ আর আপনাকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না ॥ মনটা যেন কেমন করছে, আর একটু বসুন না গল্প করি।
-গল্প আর কি করবো। গল্প তো শেষ করেছি। ওটা ছিল আমার অনেক দিনের জমানো গল্প বুঝলে ?
-তাই। ওই গল্পটা যে আমার মনেও ছিল। তা আগে বলোনি কেন ?
-বলার সাহস হয়নি যে ?
-আচ্ছা হাসিনা তুমি আমাকে আপনি আপনি বলো কেন ? তুমি বলতে পারো না ॥
-আমি ছোট থেকে আপনাকে আপনি বলে এসেছি-তাই বলতে পারছি না॥
-আচ্ছা হাসিনা আজ যাই আবার আসবো ।
-আসবেন কিন্তু আবার ?
-আচ্ছা ঠিক আছে। এই বলে যেতে ধরলে হাসিনার মা বলে উঠে।
-সেকি উঠলে কেন ? খেয়ে যাবে। খাবার তৈরী করেছি। হাসিনা খাবার এনে দে।

চলবে —

(ছবি গুগোল)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *