দগ্ধ হৃদয় (প্রথম র্পব)
ইসহাক আলী প্রামানীক
ভোর বেলা ॥ সূর্য ক্রমেই বেড়ে উঠছে ॥ তখন মৌলভী আজিজ মিয়া তাঁর বৈঠকখানায় বসে কি যেন ভাবছেন। এমন সময় ডাক পিয়নের সারা পেয়ে, তাকে ডাকলেন ॥ ডাক পিয়ন তার সামনে আসলে বললেন,
– কি খবর ?
– আপনার বেতনের খবর জানতে চেয়েছিলেন না তাই জানাতে এসেছি ॥
– তা ধন্যবাদ তোমাকে, টাকাটা নিয়ে আসতে বলেছিলাম যে, তা এনেছো।
-হ্যা তাও এনেছি ॥ আপনি শুধু এইখানে একটু সই করে দিন ॥ আমার একটু তাড়া আছে অনেকগুলো মানি অর্ডার বিলি করতে হবে ॥
মৌলভী সাহেব সই করে টাকা নিয়ে পিয়নকে বিদায় করলেন। এমন সময় বারো/তেরো বৎসরের একটি মেয়ে এসে দাড়ালো। পিয়ন তৎক্ষণাৎ চলে গেছে।
-আব্বা লোকটি কেনো এসেছিলো।
-লোকটি ডাক পিয়ন, মৌলভী সাহেব বললেন ॥
-আব্বা এখানে কি দিয়ে গেলো ॥
-আমার বেতনের টাকা ॥
-দেখি আব্বা টাকা গুলো ॥ তখন মৌলভী সাহেব, টাকা গুলো মেয়ের হাতে দিলেন।
মেয়ে টাকা গুলো দুই ভাগ করে বললো আব্বা এগুলো আপনি নেন ॥ আর বাকী গুলো আমার, আমি এটা দিব না ॥
-কেন তুমি কি করবে ?
-আমি যে আপনাকে কতকগুলো জিনিষ আনতে বলেছিলাম, সেগুলো তো আনেন নি, বলেছিলেন বেতন পেলে এনে দিবেন।
-ও আচ্ছা, তা না হয় সামনের মাসের বেতন পেলে এনে দেই।
-তাহলে ঠিক আছে নিন টাকাগুলো, তবে কথা রইলো সামনের মাসে অবশ্যই কিনে দিবেন কিন্তু।
-আচ্ছা বললামতো কিনে দিবো। এ মাসে অনেক কাজ তাই টাকা গুলোর দরকার।
-ঠিক আছে আব্বা আপনি যদি সামনের মাসে না কিনে দেন তবে আমি আর স্কুলে যাবো না কিন্তু।
-অবশ্য দেবো মা।
-এমন সময় এনামুল নামে একটা ছেলে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করলো। ছেলেটির স্বাস্থ্য মাঝারী ধরনের। বয়স প্রায় পনেরো ষোল বৎসর হবে। সে প্রত্যহ একবার করে এ বাড়ীতে আসতো। তাই সে আজও এসেছে। সে এসেই হাসিনার পড়ার ঘরে সরাসরি চলে যেতো।
মৌলভী সাহেবের এই মেয়ের নাম হাসিনা। আদর করে মৌলভী সাহেব তাকে বুলবুলি বলে ডাকেন। ইনামুল আজও এসে সোজা হাসিনার পড়ার ঘরে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখে হাসিনা নেই। এখন সে আর কোন ডাকাডাকি না করে বাড়ী চলে গেলো।
পরে হাসিনা বৈঠক খানা থেকে ফিরে এসে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিলো। যাতে দুষ্ট ছেলেরা তার সাথে নৌকায় পার হতে না পারে তাই একটু আগেই নদীর ঘাটে চলে গেলো। কিন্তু ঘাটে গিয়ে দেখে দুষ্ট ছেলেরা তার আগেই ঘাটে পৌছে অপেক্ষা করছে।
দলের নেতা আব্দুস সামাদ, সৈয়দ আলী ছোটদের নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আব্দুস সামাদ ছোটদেরকে বলল, কাশেম তোরা নৌকায় চড়ে থাক যখন হাসিনা আসবে তখনই নৌকা ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করবি। আর আমরা ডাক দিলেই নৌকা ভিড়াবি বুঝলি ॥ এই বলে বড়রা সরে পড়লো ॥
একটু পরেই হাসিনা এসে নৌকায় উঠলো। তখন ওরা নৌকা ভাসিয়ে দিলো।
-এই কাশেম নৌকা চাপা, আমরা যাবো ॥
কাশেম নৌকা ভিড়ানো চেষ্টা করলো॥
-এই কাশেম আমাকে আগে যদি পার করে দেস তবে তোকে পাকা পেয়ারা দেবো। হাসিনা বললো ॥
-আজ দিবে তো।
-হ্যা বিকালেই তোকে স্কুল থেকে এসে দেবো ॥
কাশেম পেয়ারা দেয়ার কথা শুনে খুব খুশী হয়ে রাজী হয়ে নৌকা চালাতে শুরু করলো ॥ কিন্তু কাশেমের আশা নিরাশ হলো ॥ কাশেম ছামাদের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ওকে ঘুষি দেবে বলে ভয় দেখাচ্ছে ॥ কাশেম মার খাওয়ার ভয়ে নৌকা কিনারায় ভিরিয়ে দিতে লাগলো। তখন হাসিনা বললো এই ওরা যদি আজ নৌকায় উঠে তবে আমি নৌকা ডুবিয়ে দেবো যাতে সবাই ডুবে যাস কারন তুইতো সাতার জানিস না তখন কি করবি?
-কিন্তু নৌকা না ভিড়ালে যে ওরা আমাকে মারবে ?
-কি বললি নৌকা না ভিড়ালে ওরা তোকে মারবে, এত সাহস ওদের আজই আমি আব্বাকে বলে দেবো যাতে ওদেরকে শাস্তির ব্যবস্থা করে?
কিন্তু তবু কাশেমের মনে ভয় যদি মারে। তাই সে নৌকা কিনারায় ভিড়াতে বাধ্য হলো।
-এই তবে আমাকে নামিয়ে দে, হাসিনা বললো।
-তৎক্ষণাত ছামাদের দল নৌকায় তাড়াতাড়ি উঠে পরেছে। এমন সময় দূর থেকে কাশেমকে কে ডেকে বললো-
-এই নৌকা থামা আমি যাবো।
সকলেই পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে ইনামুল কিনারায় এসে দাড়িয়েছে। সে দুষ্টদের কথা আগেই শুনেছে, তাই নদীর ঘাটে আসতে বাধ্য হলো। নৌকার কাছে এসে বললো এই নৌকা কিনারায় চাপিয়ে দে। কাশেম বাধ্য হলো নৌকা চাপিয়ে দিতে।
-হাসিনা নেমে আয়। ওদের সাথে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি তোকে অন্য নৌকায় পার করে দেবো। ওদের শলা পরামর্শ করতে শুনেছি সকালে। তোকে ওরা আজ জব্দ করবে।
-কথা শুনে সামাদের দল চমকিয়ে উঠলো ॥ ইনাম ভাই জানলো কেমন করে? আজ তাহলেতো আমাদের কপালে খারাপ আছে।
-হাসিনা নৌকা থেকে নেমে পড়লো এবং অন্য নৌকায় উঠে বসলো। তখন ইনামুল ওই নৌকায় উঠে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে ওপারে যেতে লাগলো।
ছামাদ বললো এই ইনামুল কাজটা ভালো করলি না। ও তোর কে হয় হে, কিসের জন্য এতো মাতাব্বরি।
তখন আবুল রাগে গড় গড় করতেছিল। রাগ থামাতে না পেরে ইনামুলকে বলে উঠল, বেশী মাতাব্বরি করবি না বুঝলি।
দেখ আবুল এসব নোংরামী করা তোর শোভা পায় না ॥
-ও তোর কে হয় হে ? ওর জন্য তোর অতো দরদ কিসের ?
-ও আমার ছোট বোনের মতো ॥ তাছাড়া নৌকা ডুবে যাবে বলে ওর খুব ভয় হচ্ছিল।
-কি আমার বোনরে ॥ নিজের বোনের খবর নেই পরেরটা নিয়ে টানা টানি॥
-এই চুপ বেয়াদব, তোদের মতো নোংরা আমি নই ॥ যে যেখানে সেখানে নোংরামি করবো আর মার খেয়ে বেড়াবো ॥
-কি বললি শালা আমরা পরের কিল খেয়ে রেড়াই ॥ কোন দিন দেখেছিস কিল খেতে ॥
-ওই তো সেদিন জানু মোল্লার ঘাটে তুই আর সামাদ কেমন ধোলানিটা খেয়েছিলি, আজই মনে নেই।
-এই শালা চুপ কর, ইনামুল বেশী ভালো হবে না তোর।
-তখন আবুল বলে উঠল, এই শয়তানেরা ভাগ এখান থেকে, নইলে নদীতে ডুবিয়ে মারবো দুষ্টামি আর নষ্টামি তোদের দিনদিন বেড়ে চলছে। যদি আর একদিন এমন অবস্থা দেখি সেদিন বুঝবি, কত ধানে কত চাল হয়।
তখন যার যার মতো ওপার ঘাটের দিকে চুপ চাপ চলে যেতে থাকলো। কিন্তু ছামাদের দল বলতে থাকলো, এই থামলি কেন, কি করবি তোরা?
-হাসিনার বাবাকে সব ঘটনা বলে দিবো, যাতে তোদের উচিৎ শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে।
যা যা খুবতো ভয় দেখাচ্ছিস ॥ পরে দেখিস উত্তম মধ্যম যেন তোর ঘারে না পরে।
-ঠিক আছে-আজ বাড়ী যাই তারপর দেখা যাবে ॥
-এই হাসিনার বাবা তোকে কত টাকার চাকর রেখেছে হে ॥
-তখন ইনামুল ওই নৌকায় গিয়ে ছামাদের ঘার চেপে ধরলো, আবুল এসে ইনামের হাত হতে ছামাদকে ছাড়িয়ে নিল। ছামাদ ইনামুলকে মারার জন্য খুব চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু আবুলের জন্য সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। ইনামুল নেমে তার নৌকায় গেলো।
-ইতিমধ্যে ওদের নৌকা ওপারে ভিড়লো ॥ সকলেই নেমে পরলো। ইনামুল নৌকা হতে পরে নামতে যাবে। এমন সময় নদীর পারে দেখে সামাদ ও আবুল কথায় কথায় মারামারি করছে। পরে ইনামুল নৌকা থেকে নেমে দুজনের ঝগড়া থামিয়ে দিলো।
-হাসিনা নৌকায় উঠে বলতে লাগলো, আবুলের সঙ্গে কি হয়েছিল ভাই ॥
-না কিছু হয় নি। এমনি করে তর্ক করে ওরা মারামারি করছিলো ॥
-তুমি সকালে কোথায় গিয়েছিলে ॥ আমি তোমাকে খুজে এসেছি ॥
-কেন ভাই, কিসের জন্য গিয়েছিলে ?
-এই আবুলদের কথাই বলতে গিয়েছিলাম। কাল যখন আমি নদীর ঘাটে গিয়েছিলাম, তখন আবুলরা আজ কি করবে তার প্লান পাকাপাকি করছিলো ॥ তাই তোমাকে আমার সাথে আসার কথা বলতে গিয়েছিলাম ॥ তা তোমাকে না পেয়ে এমনিতেই ফিরে এসেছি ॥
-আবুল ছেলেটা বড় দুষ্ট তাই না ভাই ॥ ওকে আমার সহ্য হয় না ॥ আমি বাড়ী ফিরে সব আব্বাকে বলে দেবো।
-সত্যি তুমি কি বলে দিবে ?
-দেখনা ও প্রতিদিন রাস্তায় দুষ্টামী করে উৎপাত করে। সেই কথাটি বলবো ॥ তুমিই দেখলে তো আজকের ঘটনা ॥ ও নিশ্চয় আজ নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে মজা করতো এবং আমাকে বেইজ্জতি করার চেষ্টা করতো ॥
-ওরা মনে করেছিলো যে, ছোট ছেলেদেরকে ওপারে নামিয়ে দিয়ে নৌকা ওই ঝাউবনের ঘাটে ভিরিয়ে দিয়ে মজা করতো কিন্তু আমি থাকার কারণে তা হয়ে উঠল না ॥
-হ্যা তাই, ॥ আজ তুমি ঠিক সময়ে ঘাটে এসেছিলে বলেই রক্ষে, নইলে যে আমার কি হতো কে জানে। বাড়ী ফিরে আজ আব্বাকে বলে অবশ্যই একটা ব্যবস্থা নিতে হবে ॥ নইলে ওরা আরো ঘারে চড়বে ॥
-আগেই তোমার আব্বাকে বলনা ॥ আর একদিন দেখি, যদি পুনরায় এ ধরণের কাজ করে তবে অন্য ব্যবস্থা করবো ॥
-আর দেখনা সামাদও যে ওদের মতই হয়েছে, ওর আব্বাকে বলে একটা ব্যবস্থা করতে হবে ॥
-আর শোন তোমাকে বলছি, তুমি প্রতিদিন আমার জন্য একটু অপেক্ষা করবে ॥ আমরা একসাথে নদীর ঘাটে যাবো দেখি ওরা কি করতে পারে।
-ঠিক আছে তাই হবে। তবে তুমি যাওয়ার পথে আমাকে ডেকে দিবে, তাহলে কোন অসুবিধা থাকবে না। এক সাথে যাওয়া যাবে।
-ঠিক আছে তাই হবে।
দুজনের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে নৌকা ঘাটে ভিড়লো। তখন নৌকা বেঁধে রেখে দুই জনে নৌকা হতে নেমে পড়ল এবং তীরে এসে দেখতে পেলো, আবুল অনেক দুরে চলে গেছে ॥
-প্রায় এক কিলো মিটার দুরে তাদের স্কুল। টিনের চৌচালার দুটি পাশাপাশি ঘরে তাদের স্কুল। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর বড়টি উচ্চ বিদ্যালয় অবস্থিত ॥ নদীর ঘাট থেকে একটি সরুপথ তাদের স্কুলের দিকে গিয়েছে। স্কুলকে লক্ষ্য করে তারা দুজনেই স্কুলের দিকে যেতে লাগল। বন জঙ্গলে যেমন ডাহুক ডাঙ্গকী অন্যান্য পাখীরা কলরব করে নিরবে উড়ে বেড়ায়, ঠিক তেমনি যেন ওরা দুজনে ছোট ছোট ঝাউ বনের মধ্য দিয়ে কথোপকন্বোনের মাধ্যমে স্কুলের দিকে চলতে থাকল।
(চলবে)
ছবি ঃ গুগল
দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য নিচে লিংকে ক্লিক করুন
Recent Comments