আমাদের বিষ্ণু স্যার
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
(গতকাল রাত তিনটা কুড়ি মিনিটের সময় আমার প্রিয় স্যার পরোলোকগমন করেছেন। তার স্মৃতির উদ্দেশেই লেখাটি পোষ্ট করলাম)
পুরো নাম বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী। আমার সবচেয়ে প্রিয় স্যার। তার কাছেই আমার লেখালেখির হাতে খড়ি।
বাংলা সাহিত্যের প্রতি ছোট থেকেই আমার দুর্বলতা ছিল। ক্লাস টু ‘তে পড়ার সময়ই কবিতা মুখস্ত করা একটা নেশায় পরিণত হয়েছিল। এরপরে প্রত্যেক ক্লাসে উঠেই কয়েকটা কবিতা হুবহু মুখস্থ করে ছন্দের তালে তালে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে মাঠে মাঠে ঘুরতাম আর আবৃত্তি করতাম। আমাদের স্কুলটি ছিল টিনের চালের। বৃষ্টির দিনে ঝমঝম শব্দের তালে “বর্ষার ঝর ঝর সারাদিন ঝরছে” কবিতাটি সম্মিলিতভাবে কোরাস গাইতাম। কখনও বা ধুধু বালুচরে গরুর রাখাল হয়ে গেলে “রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও” কবিতাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মুখে চলে আসতো। প্রইমারী স্কুলের কবিতাগুলি সহজবোধ্য হলেও সেভেন এইটের কবিতাগুলি একটু জটিল হওয়ায় অর্থ খুব একটা বুঝতে পারতাম না। দুর্বোধ্য কবিতার মাঝে যে প্রকৃতির এত উপমা থাকে সেটা বিষ্ণুপদ স্যারের কাছেই প্রথম শুনেছিলাম।
১৯৭৪ সাল। ফুলছড়ি হাইস্কুলে নতুন ভর্তি হয়ে সবে ক্লাস নাইনে উঠেছি। নতুন ক্লাসে উঠার আনন্দই আলাদা।স্যারদের ক্লাস নেয়ার অপেক্ষায় আছি। ক্লাস নাইনে উঠার পর বাংলা প্রথম ক্লাস। বিষ্ণুপদ স্যার বাংলা ক্লাস নিবেন। সবাই ক্লাসে বসে আছি। ছাত্রের সংখ্যা খুব বেশি নয়, সাইন্স, আর্টস মিলিয়ে সর্ব সাকুল্যে আঠারো উনিশ জন হবে। সে সময় অল্প কিছু স্কুল ছাড়া বেশিরভাগ স্কুলেই ছাত্রের দুর্ভিক্ষ ছিল। আমাদের স্কুলে ছাত্রের দুর্ভিক্ষ না থাকলেও পরিমাণ খুব বেশি নয়।
কিছুক্ষণ পরেই স্যার একটি ছাত্রদের হাজিরা খাতা, দু’তিনটি চক পেন্সিল, একটি ডাস্টার এবং একটি বাঁশের তৈরী ছাত্র পিটানো বেত হাতে নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। সে সময় ক্লাসে ঢোকার সময় প্রত্যেক স্যারের হাতেই একটা করে বেত থাকতো। কারণ একে তো ছাত্ররা পড়তো না তারোপর হাই স্কুলের অনেক ছাত্রই দুষ্টামির পাশাপাশি বিবাহযোগ্যও ছিল। তাদেরকে কন্ট্রোলে রাখতে দু’হাত লম্বা বেতই একমাত্র ঔষধি হিসাবে কাজ করতো। তবে স্যার সবসময় বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেও অপারগ না হলে কখনই বেত কারো পিঠে প্রয়োগ করতেন না।
স্যার ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথেই সবাই দাঁড়িয়ে আদাব স্যার বলে চিল্লিয়ে উঠলাম। আমাদের সময় স্যারদের এভাবেই সম্মান জানানো হতো। সম্মান জানানোর পর স্যার সবাইকে বসতে বললেন। সবাই বেঞ্চিতে যার যার আসনে বসলে স্যার রোল কল করতে লাগলেন। যেহেতু ছাত্রের পরিমাণ খুব বেশি নয় সেই কারণে রোল কল করতে খুব বেশি সময় লাগল না। রোল কল শেষ করেই স্যার বাংলা পড়ানো শুরু করলেন। প্রথম কবিতাটিই ছিল পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের কবর কবিতা। নতুন বই হাতে পেয়ে প্রথমেই কবিতাটির আটলাইন মুখস্থ করেছিলাম। স্যার কবিতার প্রথম দুই লাইন উচ্চারণ করলেন– এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। স্যার দুই লাইন পাঠ করেই তার অর্থসহ এবং উপমাসহ বুঝাতে লাগলেন। আমি কখনই মনোযোগী ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু স্যারের বাচনভঙ্গী এবং পড়ানোর ধরন দেখে মনের অজান্তেই ক্লাসের প্রতি মনোযোগী হয়ে গেলাম। কবিতার প্রতিটা লাইন যেন চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ভাসতো লাগল। স্যারের লেকচার তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম। স্যার বাংলায় সেই সময়ের রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পাস ছিলেন। স্যার এতসুন্দর করে কবিতা পড়াতে লাগলেন ক্লাসেই আমার কবিতার খুটিনাটি অনেকটা মুখস্ত হয়ে গেল। এর আগেও বাংলার অনেক ক্লাস করেছি কিন্তু এত সুন্দর করে কোন স্যারই বুঝাতে পারে নাই। এই প্রথম বাংলা ক্লাসে স্যারের লেকচার শুনে মুগ্ধ হলাম। স্যারের ক্লাসেই প্রথম ব্যাখাসহ কবিতা আমার মাথায় ঢুকল। এর পরে কঠিন কঠিন কবিতাগুলিও আমার কাছে কিছুটা সহজ মনে হতে লাগল। স্যারের প্রথম ক্লাসেই আমার মধ্যে কবি কবি ভাব এসে গেল। কবিতার ছন্দ মাথায় ঘুরতে লাগল। কয়েক দিন পরেই ছোটখাটো একটি ছড়াও লিখে ফেললাম। পর পর কয়েকটি কবিতা লিখে স্যারকে দেখালাম। স্যার কবিতা দেখে আমাকে খুব উৎসাহ দিলেন এবং কিছু কবিতা কারেকশনও করে দিলেন। এর পর থেকে মাঝে মাঝেই স্যারকে আমার লেখা কবিতা দেখাতাম এবং সংশোধন করে নিতাম।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর স্যারের সাথে যোগাযোগ কমে গেল। কারণ স্কুল ছিল আমার বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে আর কলেজ হলো আমার বাড়ি থেকে পনরো/ষোল কিলোমিটার উত্তরে। যে কারণে স্যারের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হতো না।
কলেজে পড়া অবস্থায় আমার ইংলিশ গ্রামার পড়ার প্রয়োজন দেখা দিল। সে সময় এক মাস গ্রীষ্মের ছুটি ছিল। আমি, আমার কলেজের সহপাঠি বাবু এবং বাকী মিয়া এই তিনজন একত্র হয়ে স্যারের বাড়িতে প্রাইভেট পড়তে গেলাম। স্যার প্রথমে রাজী হচ্ছিলেন না, কারণ সেই সময় স্যারেরা প্রাভেট পড়ানো পছন্দ করতেন না। কিন্তু আমার অনুরোধে তিনি অবশেষে পড়াতে রাজি হলেন।
আমার বাড়ি থেকে স্যারের বাড়ি প্রায় আট দশ কিলোমিটার দূরে। এতদূর রাস্তা তখন আমার কাছে খুব একটা দূর মনে হতো না। তারুণ্যের কাছে দূরুত্ব হার মেনে যেত। আমি কখনও বাই সাইকেলে চরে আবার কখনও পায়ে হেঁটে স্যারের বাড়ি পড়তে যেতাম।
স্কুল জীবনে স্যারের পদবী জানতাম না কিন্তু স্যারের বাড়ি গিয়ে বুঝতে পারলাম স্যার খাঁটি ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ হলেও তিনি আধুনিক মনের এবং আমাদের সাথে যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। কখনই তিনি আমাদের সাথে ব্রাহ্মণত্ব স্বভাব দেখান নাই।
স্যার আমাদের প্রতি কতটা আন্তরিক ছিলেন তা একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই বুঝতে পারবেন। জৈষ্ঠ্য মাসে হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন জামাই ষষ্ঠি পালন করে থাকে। আমাদের সেই দিনটি জানা ছিল না, স্যারও আমাদের বলে নাই। আমরা তিনজনই স্যারের বাড়িতে গিয়ে হাজির। যাওয়ার পরে স্যার বললেন, তোমরা এসেছো ভালই হয়েছে, গতকালকেই আমার নেমন্তন্ন করা উচিৎ ছিল কিন্তু আমি বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা আশ্চার্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, কিসের নেমন্তন্ন স্যার! স্যার হাসি দিয়ে বললেন, আজকে আমাদের জামাই ষষ্ঠির দিন। আজকে তোমাদের পড়াবো না, তবে তোমরা আমার এখানে খেয়ে যাবে। এমন একটা দিনে উপস্থিত হওয়া নিয়ে আমরা ইতস্তত করতে লাগলাম- বললাম, ঠিক আছে স্যার, আমরা আজ আর পড়বো না আগামী কাল আসবো। বলেই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে স্যার আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, চলে তো যাবেই- তবে তিনজনই খেয়ে যাবে। আমরা খেতে ইতস্তত করায় স্যার হাসি হাসি মুখে বললেন, আমার বাড়ি এসে না খেয়ে চলে যাবে আমি কি তাই যেতে দিতে পারি? তোমাদের বাড়িতে গেলে তোমরা কি আমাকে চলে আসতে দিবে? স্যারের এমন প্রশ্নমূলক বাক্যে না করার সাহস হলো না। অবশেষে স্যারের আন্তরিকতাপূর্ন নেমন্তন্ন গ্রহণ করতে বাধ্য হলাম।
স্যারের কাচারি ঘরেই প্রেইভেট পড়তাম। সেই কাচারি ঘরের মেঝেতে বড় বড় তিনটি কাঠালের পিঁড়ি এনে দিলেন। আমরা তিনজন তিন পিঁড়িতে বসে পড়লাম। স্যার বাড়ির ভিতর থেকে নিজ হাতে বড় বড় কাঁসার থালা ভর্তি ফলার নিয়ে আসলেন। প্রতিটা থালায় বিভিন্ন ধরনের অনেকগুলো আম, সাথে কাঁঠাল, চাল চিড়া (চাল থেকে তৈরী বিশেষ ধরনের চিড়া যেটা উত্তারাঞ্চলে পাওয়া যায়), খই, মুড়ি, দই এবং কাঁসার বাটি ভর্তি দুধ। খাবার পরিমাণ দেখে চক্ষু চড়কগাছ। এত খাবার কি করে খাবো সেই চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতকিছু খাবার দেয়ার পরও স্যার বলছে, তোমরা এগুলো খাও আমি আরো আম দুধ নিয়ে আসছি। স্যারের কথা শুনে কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। আমাদের মধ্যে বাকী মিয়া একটু বাক পটু ছিল। সে বলল– স্যার, যে পরিমাণ খাবার দিয়েছেন এগুলো খেয়েই তো নড়তে পারবো না, আরো খাবার দিলে আমাদের পক্ষে আর বাড়ি ফেরাই সম্ভব হবে না। স্যার হাসি দিয়ে বললেন, কি বলো তোমরা– এই বয়সে খাবে না তো কোন বয়সে খাবে। খেতে থাকো, লজ্জা করবে না। ভিতরে অনেক খাবার আছে। স্যারের কথা শুনে তিনজনই বলে উঠলাম, এগুলোই আমাদের বেশি হয়ে যাবে স্যার, আর কোন খাবার আনবেন না স্যার।
খাবারের পরিমাণ বেশি হওয়ায় অনেক কষ্ঠ করেই খাওয়া শেষ করতে হলো। কারণ, খাবারের পরিমাণ এত বেশি যে খেতে খেতে মনে হলো গলা পর্যন্ত ভরে গেছে। খাওয়া শেষে স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। রাস্তায় এসে বাকী মিয়া আর হাঁঠতে পারছে না। একে তো খাওয়া বেশি হয়েছে তারোপর জৈষ্ঠ্য মাসের দুপুরের চড়া রোদ এবং ভ্যাপসা গরম। এইসব কারণে কিছুদূর এসেই বাকী মিয়া রাস্তার পাশের এক গাছের ছায়ায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। আমরাও গাছের নিচে বসে বাকী মিয়ার মাথার কাছে ঝিমুতে লাগলাম। অনেক পড়ে আমাদের ঝিমুনিভাব কেটে গেলে গাছের ছায়া থেকে উঠে যে যার মত বাড়ি চলে গেলাম। প্রায় তেতাল্লিশ বছর পূর্বে স্যারের বাড়ি খেয়েছিলাম, সেই ফলাহারের স্মৃতি আজো ভুলতে পারি নাই।
উনিশশ’ সাতাশি সালে পত্রিকা জগতে চাকরি নেয়ার কিছুদিন পরেই আমি স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। কারণ আমার লেখালেখি করার প্রেরণা উনার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম, আমি পত্রিকা জগতে চাকরি পেয়েছি এটা জানলে স্যার হয়তো খুশি হবেন, এমন ভাবনা থেকেই স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু স্কুলে গিয়ে দেখি স্যার আসে নাই, পরে আরো কয়েকদিন স্কুলে গিয়েও স্যারের দেখা পেলাম না, স্যার কোথায় আছে কেউ বলতেও পারল না।
প্রায় চল্লিশ বছর পর জাপান প্রবাসি আমার গ্রামের ছোটভাই রহমান মাহবুবের মাধ্যমে ফেসবুকে স্যারের ছেলের সন্ধান পেলাম। ফেসবুকের মেসেঞ্জারের মাধ্যমেই তার কাছ থেকে স্যারের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন করার চেষ্টা করে ব্যার্থ হলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম স্যার যেখানেই থাকুক একদিন না একদিন স্যারকে খুঁজে বের করবোই। এবার কোলকাতা গিয়ে প্রথমেই স্যারকে ফোন দিলাম। রিং হলো কিন্তু কেউ ধরল না। কিছুক্ষণ পর দেখি স্যারের নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। রিসিভ করে আমার পরিচয় দেয়ায় উনি খুব খুশি হলেন। অনেক দিন পর উনার এক ছাত্র ফোন করেছে এই আবেগে অনেকটা কেঁদেই ফেললেন। স্যারের শারিরিক অবস্থা জিজ্ঞেস করায় তিনি তার সমস্যার কথা জানালেন। স্যার অনেক দিন হলো অসুস্থ্য। খুব একটা হাঁটা চলা করতে পারেন না। অসুস্থ্য না হলে হয়তো তার সাথে আরো অনেক আগেই যোগাযোগ হতো। স্যার অনেকের খোঁজ খবর নিলেন। ইচ্ছা ছিল স্যারের সাথে দেখা করবো কিন্তু নিজে অসুস্থ্য থাকার কারণে আমার পক্ষে দেখা করা সম্ভব হলো না। পরবর্তীতে চেষ্টা করবো স্যারের সাথে দেখা করার। এ যাত্রা স্যারের সাথে দেখা করতে না পারলেও স্যারের সাথে কথা বলে অনেকটা মানসিক প্রশান্তি পেলাম। অনেক দিনের ইচ্ছা পুরণ হলো। এটাও আমার জন্য অনেক কিছু। আগামী দিনগুলির জন্য স্যারের দীর্ঘায়ু কামনা করি। স্যার যেন সুস্থ্য হয়ে আরো অনেক দিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকেন।
Recent Comments