বাইলা মুন্সীর জেলখানা

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আমাদের গ্রামের পূবের গ্রামে বাস করতেন বাইলা মুন্সী। ভাল নাম মোঃ ওসমান। হাবাগোবা এবং সহজ সরল হওয়ায় এলাকার সবাই তাকে ‘বাইলা মুন্সী’ নামে ডাকতো। গ্রামের ভাষায় ‘বেলে’ মাছকে ‘বইলা’ বলা হয়। এই মাছটি তেমন চালক চতুর বা চঞ্চল নয়। যে কারণে অন্য মাছের চেয়ে সহজেই পানির ভিতর হাত দিয়ে ধরা যায়। হয়তো ছোট কালে বন্ধু বান্ধবরা তার হাবাগোবা চাল চলনের কারণেই রসিকতা করে ‘বেলে মাছের’ সাথে তুলনা করে এই নামে ডাকতে শুরু করে। রসিকতা করে ডাকতে গিয়ে একপর্যায়ে ’বাইলা’ নামটিই বহাল হয়ে যায়। বর্তমানে ওসমান নামে অধিকাংশ মানুষই চেনে না।

পাকিস্তান আমলে গ্রামে বাংলা লেখাপড়া জানা লোকের যেমন অভাব ছিল তেমনি কোরান শরীফ পড়তে পারে এমন লোকেরও অভাব ছিল। টেনেটুনে কোরান শরীফ পড়তে পারলেই তাকে মুন্সী বলা হতো। বাইলা মুন্সীও কোরান শরীফ পড়তে পারতেন। কোরান শরীফ পড়ার কারণে তাকে ‘বাইলা’ নামের সাথে ‘মুন্সি’ শব্দটি যোগ করে ‘বাইলা মুন্সি’ বলা হতো। তবে তাকে কোরান খানির দাওয়াতে কোরান শরীফ পড়তে দেখলেও কোনও মসজিদে নামাজের ইমামতি করা বা মিলাদের দাওয়াতে কখনও মিলাদ পড়াতে দেখিনি।

খুবই গরীব মানুষ, অন্যের বাড়ি কাজ না করলে পেটের ভাত জোটে না। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই কামলা কিষাণ দিত। সহজ সরল হওয়ায় আমার বাবাও তাকে ভাল বাসতেন। অন্যদিকে তিনি দুর সম্পর্কের কিছুটা আত্মীয়ও ছিলেন।

১৯৬৯ সালের একটি ঘটনা। বাইলা মুন্সীসহ আরো চারজনে মিলে আমাদের গ্রামের উত্তরের গ্রামে নাওয়ালা ছৈদালীর ছন ক্ষেতে চুক্তিতে ছন কাটার কাজ করেছেন। নাওয়ালা ছৈদালী নাম হওয়ার কারণ হলো, তার একটি বাইচের নৌকা ছিল। এই নৌকা দিয়ে তিনি বর্ষাকালে নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করতেন এবং অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। নৌকা বাইচে শীল, কাপ পুরস্কার পেলে খুশির চোটে গরু খাশি দিয়ে এলাকার লোকজনকে মাঝে মাঝে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। এদিক দিয়ে ছৈদালীর খুব সুনাম ছিল। যে কারণে ‘নাওয়ালা ছৈদালী’ বললে একনামে সাত গ্রামের মানুষ চেনে।

পাঁচ জনে ছৈদালীর ছন কাটার কাজ করলেও মুজুরী বাকী থাকে। কোনো কারণে ছৈদালীর সাথে বাইলা মুন্সীদের ছন কাটার মুজুরী নিয়ে ঝগড়া হয়। এতে ছৈদালী মুজুরী দিতে গড়িমসি করে। বাইলা মুন্সীর দলের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষেতে থাকা ছনখড় জড়িয়ে বোঝা বেঁধে মাথায় করে যার যার মত বাড়ি নিয়ে যায়। বাইলা মুন্সীও সবার দেখাদেখি কিছু ছনখড় বোঝা বেঁধে মাথায় তুলে বাড়ি নিয়ে আসে।
বাইলা মুন্সীরা জোর করে ছনখড় ক্ষেত থেকে নিয়ে যাওয়ায় ছৈদালী খুব অপমানবোধ করে এবং ক্ষিপ্ত হয়। গ্রামে শালিস বিচার না করে সোজা থানায় গিয়ে বাইলা মুন্সীসহ পাঁচজনের নাম উল্ল্যেখ করে চুরির কেস দেয়। এই কেস সম্পর্কে অন্যরা কিছু জানলেও বাইলা মুন্সী কিছুই জানে না। হঠাৎ একদিন পুলিশ এসে অন্যদের ধরতে না পারলেও সহজ সরল বাইলা মুন্সীকে ধরে নিয়ে যায়। পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেলেও ছাড়ানোর জন্য কেউ তার পক্ষে কোনো প্রকার সুপারিশ করেনি। পুলিশ পরদিন থানা থেকে কোর্টে চালান করে দেয়। বাইলা মুন্সীর পক্ষে কোন জামীনের আবেদন না থাকায় বিচারক কোর্ট হাজতে প্রেরণ করেন।

সাত দিন হয়ে যায় তার পক্ষে কেউ কোর্টে যায়নি। কারণ, একে তো তার পক্ষে কোর্টে যাওয়ার মত লোকজন নেই, তারোপর গরীব মানুষ টাকা পয়সা নেই। বাইলা মুন্সীর বউ বাচ্চা সকাল বিকাল বাবার কাছে এসে কান্নাকাটি করতে লাগল। তাদের কান্নাকাটিতে বাধ্য হয়ে বাবা সাতদিনের দিন কোর্টে গিয়ে পরিচিত মোক্তার ধরে জামিনের দরখাস্ত করলেন এবং জামিন মঞ্জুর হলো। বাইলা মুন্সীকে জেল থেকে বের করে আনতে সেই সময়ে বাবার সর্বসাকুল্যে ৩৭ টাকা খরচ হয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে এসে জামিনে খরচ করা ৩৭ টাকাও বাইলা মুন্সীর পক্ষে পুরোপুরি পরিশোধ করা সম্ভব হয় নাই। কামলা দিয়ে অর্ধেক টাকা পরিশোধ করলেও বাকি অর্ধেক টাকা বাবা মাফ করে দিয়েছেন।

আমাদের বাড়ি থেকে গাইবান্ধা শহর কোনাকোনিভাবে সাত মাইল রাস্তা। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে ঘুরে গেলে এগারো মাইল হয়। তখন রিক্সার খুব একটা প্রচলন ছিল না। শহর এলাকায় রিক্সা চললেও গ্রামের রাস্তায় রিক্সা আসতো না। গ্রামে চলাচলের জন্য গরুর গাড়ির পাশাপাশি দ্রুতগামী বাহন হিসাবে কিছুটা সাইকেলের প্রচলন ছিল। তবে এ বাহনটি সবার ঘরে ঘরে ছিল না হাতে গোনা গ্রামের কয়েকজনের কাছে ছিল। বাবা ব্রিটিশ আমল থেকেই সাইকেল চালাতেন। সেই সময়ে তিনি বিশ টাকা দিয়ে রেলি নামের সাইকেল কিনেছিলেন। সাইকেলের দামের পরিমাণ শুনলে গালগল্প মনে হয় কিন্তু তখন এটাই বাস্তব ছিল। গ্রামের ভাঙাচুড়া মাটির রাস্তায় সন্ধ্যার আগে আগে বাবা সাইকেলের পিছনে বসিয়ে বাইলা মুন্সীকে গাইবান্ধা থেকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলেন।

জেলখানা থেকে বের করে আমাদের বাড়িতে আনার সাথে সাথে পুরো এলাকায় বাইলা মুন্সীর ফেরার খবর ছড়িয়ে গেল। এলাকার মানুষ জন বাইলা মুন্সীকে দেখার জন্য ছুটে এলো। মুহর্তেই বাড়ি লোকজনে ভরে গেল। বাইলা মুন্সীকে মা ভাত খেতে দিয়েছেন। ভাত খাওয়ার পরে উঠানের মাঝখানে জলচৌকিতে বসিয়ে একেক জন একেক ধরনের প্রশ্ন করছে। বাইলা মুন্সী যতটা সম্ভব উত্তর দিচ্ছেন। মফিজ ভাই কিছুটা রসিক ধরনের লোক। সম্পর্কে বাইলা মুন্সীর বড় ভায়রার ছেলে। সে এসে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা খালু. জেলখানা আপনার কাছে এই কয়দিন কেমন লাগল?
সহজ সরল মানুষ সহজ সরল ভাবেই উত্তর দিলেন। বাবারে– আমার যদি বউ আর দুইডা বাচ্চা না থাকতো, তাইলে আমি আর জেলখানা থিকা আইতাম না।
মাফিজ ভাই আশ্চার্য হয়ে প্রশ্ন করল, কন কি খালু! মানুষ জেল খানায় যাইবার চায় না, আর আপনি জেল খানা থিকা আইবার চান না, কারণ কি খালু?
বাইলা মুন্সী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আফসোসের সুরে বলল, বাবারে, বছরে একদিন মাংস পাই না, সারা বছরে একটুকরা ইলিশ মাছ ভাগ্যে জোটে না, মাছ কেউ খাওয়াইলে খাই না খাওয়াইলে না খাই, সেইখানে জেলখানায় একদিন ইলিশ মাছ, দুই দিন মাংস, তিনদিন মাছ ভাত আর একদিন সবজির নাবরা দিয়ে খাইবার দেয়। সারা দিন কাম কাজ নাই, খালি শুয়ে থাকা আর তিন বেলা ভাল মন্দ খাওয়া। নামাজের সময় হইলে পুলিশ ডাক দিয়া যায় উইঠা নামায পড়ি। এইরকম সুখ তো বাবা আমার জীবনে আর কোনখানে পাই নাই। কাজ কাম ছাড়া খাওয়া, ঘুমান আর নাময পড়া, এইরকম সুখ রাইখা আইতে কি মন চায়?
মফিজ ভাই তার কথা শুনে হাসি হাসি মুখে রসিকতা করে বলল, তাইলে খালু জেল খানার এত সুখ রাইখা আইলেন ক্যা?
— বাবারে, আমি তো আইবার চাই নাই, এই বাড়ির মতবর সাব আমারে জোর কইরা বাইর কইরা নিয়া আইল।
বাইলা মুন্সীর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। বাবা উত্তর দুয়ারী ঘরের বারান্দায় বসা ছিলেন। বয়স্ক একজন বাবাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি গো মতবর সাব, বাইলা মুন্সী তো জেলখানায় সুখেই আছিল, হে তো আইতে চায় নাই, আপনি তারে জোর কইরা নিয়া আইলেন ক্যা?
বয়স্ক লোকটির কথা শুনে বাবা তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, কেডা কইছে?
— বাইলা মুন্সী নিজেই তো কইতেছে।
বাবা ঘরের বারান্দায় বসা থেকে উঠে এসে বাইলা মুন্সীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, এই বাইলা, তুই নাকি জেল খানা থিকা আইবার চাস নাই, তোরে জোর কইরা আনছি?
বাইলা মুন্সী বাবার প্রশ্নে মাথা না তুলেই নিচের দিকে মুখ করে বলল, হ মতবর ভাই, আমি জেল খানায় ভালই আছিলাম। হুদাই বাইর কইরা নিয়া আইলেন।
বাবা বাইলা মুন্সীর কথা শুনে আশ্চার্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাইনষে জেলখানা দেখলে ভয় পায়, আর তুই জেলখানায় কি এমন শান্তি পাইলি যে জেলখানায় থাকবার চাস!
কথা শুনে বাইলা মুন্সী বাবার মুখের দিকে একবার মুখ তুলে তাকিয়েই মাথা নিচু করে বলল, জেলখানায় তো ভালই আছিলাম, কাম কাইজ নাই, তিন বেলা খাওয়া আর ঘুমায়া থাকা, এই রকম শান্তি তো কোন দিন বাড়িতে পামু না।
বাইলা মুন্সীর কথা শুনে বাবা ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে বলল, আরে ব্যাক্কল, তুই না হয় শান্তিতে খাইলি, ঘুমাইলি, থাকলি, তোর বউ বাচ্চারা খায় কি, সেইটা একবার ভাইবা দেখছোস?
যে লোকটি জীবনে কোনদিন অবসর পায় না, সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে পেট ভরে খেতে পায় না, সেই লোকটি জেলখানায় বসে বসে তিন বেলা কাজ কর্ম ছাড়া মাছ, গোশত দিয়ে ভাত খেয়েছে, এই আরাম আয়েশের কথা চিন্তা করতে গিয়ে এতক্ষণ বউ বাচ্চার কথা তার মনেই ছিল না। বাচ্চাদের কথা বলতেই বাইলা মুন্সী যেন সম্বিত ফিরে পেল। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, হ মতবর ভাই, পোলা দুইডার কথা মনে হইলে খাওন দাওন ভাল লাগে নাই। রাইতে পোলা দুইডার কথা মনে হইলে বইসা বইসা কানছি। বলেই সে কাঁদতে লাগল।
বাইলা মুন্সির কান্না দেখে উপস্থিত লোকজন রসিকতা ছেড়ে চুপ হয়ে গেল। এর মধ্যে ভির ঠেলে কে একজন তার দুই ছেলেকে বাইলা মুন্সীর সামনে এনে দিলো। মুন্সী ছোট ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন। তার কান্না দেখে উপস্থিত লোকজনেরও চোখে পানি চলে এলো। এ অবস্থায় কেউ তাকে আর কোনো প্রশ্ন করল না।
বাইলা মুন্সীর কান্না অবস্থায় মা এক সের চাল আর কিছু লবন, মরিচ, ডাল একটি পোটলায় বেঁধে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি বাড়ি যান, আপনার বউ বাচ্চারা সারা দিন না খায়া আছে।
বাইলা মুন্সীর বউ আমাদের বাড়িতেই বসে ছিল। সে উঠে কাছে গেলে বাইলা মুন্সী চালের পোটলাটি বউয়ের হাতে দিয়ে ছোট ছেলেটিকে কোলে আর বড় ছেলেটিকে ডান হাতে ধরে বাড়ি রওনা হলেন।

বাইলা মুন্সী জেলখানার চারদেয়ালের ভিতরে আটক থেকেও সাতদিন যে আরাম আয়েশ করেছে এটাই হয়তো তার জীবনের কাজকর্ম বিহীন চরম আরাম আয়েশ। বাড়িতে আসার পর আর একদিনও শুয়ে-বসে ভাল-মন্দ খাওয়ার সৌভাগ্য হয় নাই। শুয়ে থেকেছে তো ভাত জোটে নাই ভাত জুটেছে তো শুয়ে থাকা সম্ভব হয় নাই। কারণ জেলখানা থেকে বের হওয়ার পর দিন থেকেই আবার তাকে হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে পেটের ভাত জোগাড় করতে হয়েছে। সেই সময়ে সারাদিন গৃহস্থের বড়ি কাজ করে আধা সের চাল আর দেড় টাকা মুজুরীর বেশি রোজগার করা সম্ভব ছিল না। এ দিয়েই নিজেকেসহ আরো তিনটি মুখের অন্ন সংস্থান করতে হতো। একদিন বসে থাকলে একদিনই না খেয়ে থাকতে হতো। অভাব, অনটন আর অন্ন সংস্থানের অভাবের কারণেই বাইলা মুন্সীর কাছে জেলখানার চার দেয়ালের বন্দী জবনটাও সুখের মনে হয়েছিল।

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *