পরিত্যাক্ত রেল স্টেশন ভরত খালী
আমার শৈশব কৈশর যে স্টেশনের সাথে জড়িত সেই স্টেশনের নাম ভরত খালী। জীবনের প্রথম এই স্টেশন থেকেই ট্রেনে উঠেছিলাম। যতটুকু মনে পড়ে সম্ভাবত ১৯৬৫ সালে আমার উকিল নানা মাকে নিতে এসেছিল। (অনেকে হয়তো উকিল নানা শব্দটি নাও বুঝতে পারেন। মুসলিম বিয়েতে যে উকিলের দায়িত্ব পালন করে তাকেই বাংলাদেশের অনেক এলাকায় কনের বাপের দায়িত্বও পালন করতে হয়। সেই হিসাবে আমার মায়ের উকিল বাপ আমার নানা।) আমার উকিল নানার বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানা। গাইবান্ধার ফুলছড়ি এলাকা থেকে তখন রেলের স্টীমার বা নৌকা ছাড়া নানার বাড়ি যাওয়ার মত আর কোন রাস্তা ছিল না। কারণ আমাদের বাড়ি আর নানার বাড়ির মাঝখানে বিশাল যমুনা নদী। এই যমুনা নদী পাড়ি দেয়ার জন্য নদী পথের দুইটা বাহন ছাড়া আর কোন বাহন ছিল না।
আমাদের বাড়ি থেকে ভরতখালী স্টেশন প্রায় চার মাইল দূরে। তবে এই চারমাইল আমাদের হাঁটতে হয় নাই। গরুর গাড়িতে চড়েই স্টেশনে গিয়েছিলাম। স্টেশনে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বিকট শব্দে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে কয়লার ইঞ্জিনওয়ালা ট্রেন এসে হাজির। কয়লার ইঞ্জিনের কানফাটা হুইসিল শুনে ভয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমার ভয় পাওয়া দেখে মা জড়িয়ে ধরে বুকে পিঠে থুতু দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছিল। এরপর সেই ট্রেনেই তিস্তামুখ ঘাটে গিয়ে নেমে যাই। সেখান থেকে নৌকায় চড়ে বিশাল যমুনা নদী পাড় হয়ে নানার বাড়ি যাই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় যাতায়াত করার একমাত্র স্টেশন ছিল এই ভরতখালী। অন্য কোন স্টেশনের সাথে আমাদের যোগাযোগ এত কাছের ছিল না। যমুনা সেতু চালু হওয়ার পরও কয়েকবার এই স্টেশন দিয়েই ঢাকায় যাতায়াত করেছি।
১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ রেলওয়ে কোম্পানি যমুনা নদীর এপার ওপার ট্রেনের যাত্রী পারাপারের জন্য পূর্বপাড়ে জামালপুর অংশে বাহাদুরাবাদ রেলওয়ে স্টীমার ঘাট এবং পশ্চিম পাড়ে গাইবান্ধা অংশে তিস্তামুখ রেলওয়ে স্টীমার ঘাট নির্মাণ করে। বোনারপাড়া জংশন হয়ে তিস্তামুখ ঘাটে যাওয়ার সময় মাঝামাঝি পর্যায়ে একটি স্টেশন যার নাম ভরত খালী।
ট্রেনে উত্তরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য স্টেশনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই স্টেশন থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পূর্ব দিকে ফুলছড়ি এলাকায় নদীর নাব্যতা অনুযায়ী কখনও রেল লাইন পূর্ব দিকে আবার কখনও দক্ষিণ দিকে যেত। বর্ষাকালে ঘাট ফুলছড়ি এলাকায় থাকলেও শুকনা মওসুমে নদীর পানি কমে গেলে ঘাট সাঘাটা থানার দিঘল কান্দিতে চলে যেত। প্রতি বছর দুই থেকে তিনবার এই ঘাট রেল লাইনসহ দশ থেকে পনরো কিলোমিটার কখনও উত্তরে কখনও দক্ষিণে স্থানান্তর করা হতো। তিস্তামুখ ঘাট রেল লাইনসহ এদিক ওদিক সড়ানড়া হলেও ভরতখালি স্টেশনটি কখনও স্থায়ীত্ব হারাতো না। ঘাটে যাওয়ার আগে একমাত্র স্থায়ী রেল স্টেশন ছিল এই ভরতখালি। স্টেশনটি স্থায়ী হওয়ায় এখানে রেলের অনেকগুলো কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়েছিল। যে কোয়ার্টারগুলোতে ভরতখালি স্টেশনের কর্মকর্তা কর্মচারি ছাড়াও তিস্তামুখ ঘাটের কর্মচারী কর্মকর্তারা বসবাস করতো। রেল কর্মচারীদের জন্য এখানে একটি রেলের ডাক্তার খানাও ছিল।
যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কটের কারণে দুই হাজার সালের দিকে তিস্তামুখ ঘাট গাইবান্ধা শহরের পূর্বপাশে বালাসী এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে বালাসীতে ঘাট স্থায়ী করনের লক্ষ্যে তিস্তামুখ ঘাটের নাম পরিবর্তন করে বালাসী ঘাট নামকরণ করা হয়। তিস্তামুখ ঘাট ফুলছড়ি এলাকা থেকে বালাসীতে স্থানান্তর হলে ভরতখালি স্টেশন থেকে বালাসীর দূরত্ব বেশি হওয়ায় বোনারপাড়া ভরতখালি রেল লাইনের গতি পরিবর্তন করে গাইবান্ধার দক্ষিণ পাশের স্টেশন ত্রিমোহিনী থেকে নতুন রেল লাইন নির্মাণ করা হয়। আর তখন থেকেই এই স্টেশনটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে।
আগে এই স্টেশন থেকে এই এলাকার মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করতো। চব্বিশ ঘন্টা হাজার হাজার যাত্রীতে স্টেশনটি মুখরিত থাকতো। সেই স্টেশনটি পরিত্যাক্ত হওয়ায় এখন গরু ছাগলের চারণ ভুমিতে পরিণত হয়েছে। রেলের কোয়ার্টারগুলোও পরিত্যাক্ত হওয়ার পর থেকে জনবসতি না থাকায় আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন এই স্টেশনের চারদিকে কিছু কিন্নর আর নদী ভাঙা সর্বহারা ছিন্নমূলের বসবাস ছাড়া অন্যকোন জৌলূস খুঁজে পাওয়া যায় না।
Recent Comments