উপন্যাস– আঁধারে শশী (পর্ব-১)

ইসাহক আলী প্রামানিক

(এক)
পড়ন্ত বিকেল। বাড়ীটা খালি। কামাল নিজ ঘরে বসে নিজের কাজগুলো করছে। এমন সময় কাজের বুয়া ঘরে ঢুকে পড়ল ঝড়ের বেগে। তার হাতে একটা কৌটা। কামালের সামনে রেখে বলে বসল, এইটা ভাল করে দেখেন, ছ্যামড়িটার কাছে ছিল।
কামালের কৌতুহল জাগল, সে খুলে দেখেই অবাক। তবে কি তার ঘরে সাধু বেশে চোর ঢুকেছে। আমি কি অনাথ নামে যে মেয়েটিকে ঘরে আশ্রয় দিয়েছি সে একজন অসৎ ব্যাক্তি। অসৎ উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছে। তার মনে নানা প্রশ্নের অবতারনা হতে থাকল। তাই সে স্থির করল তাকে একবার জিজ্ঞেস করেই দেখি না, সে কোথায় পেল এসব। তাই তাকল, বেনু।
জরুরী তলবের সুর শুনে বেনু যেন চমকে উঠল। কামাল ভাইতো আমাকে কোন দিন আমার সাথে কথা বলে না এবং ডাকেও না। তবে আজ কেন ডাকছে সে। আম্মাতো বাসায় নেই, তবে তার মতলবটা কি? নান প্রশ্নের সম্মখীন হয়ে সে তার কক্ষের দিকে পা বাড়াল। দরজায় পা রাখতে সে চমকে গেল। একি তার হাতে ওটা কেন? আমিতো ওইটাই খুঁজছি। তবে তার হাতে গেল কি ভাবে? মিনতি নয়নে এবং জিজ্ঞাসু মনে চেয়ে দেখল বেনু কামালের দিকে।
কামাল বাঘের মত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল তার দিকে। বেনু যেন হক চকিয়ে গেল। কামাল কঠিন কণ্ঠে বলে ফেলল, এটা কি? কোথায় পেয়েছো? না চুরি করেছ? এটা অভ্যাস কত দিনের?
কামালের কথা শুনে বেনুর মাথায় হঠাৎ চাবুকের ঘা পড়ল। কানে যেন কি একটা বিকট আওয়াজ এসে কানটা যেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। সে যেন আর্তচিৎকারে বলে উঠল নান অমন কথা বলবেন না। আমি চোর নই। তার গলার আওয়াজটা যেন কেমন জড়িয়ে গেল এবং তার শরীরটা নেতিয়ে যেতে লাগল।
আরে চুরি না হলে এতদামী জিনিষ তুমি পেলে কোথায়? এখানে যখন আস তখন তোমার পড়নের ছিল একফালি পুরানো কাপড়। বেশভুষা ছিল ফকিরের মত। কামাল যেন কিছুটা বিব্রত ও রাগী সুরে বলে ফেলল কথাগুলো। কথা শুনে বেনুর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। উদাস নয়নে সে চেয়ে রইল।
এই সোনার চেইন আর কানের একজোড়া ফুল কোথায় থেকে নিয়ে পালিয়ে এসেছো? আমাকে তো নিরীহ ভেবে ঘারে এসে বসেছেন। দিব্যি আরামে দিন কাটছে। আবার এইখানে চুরি করে অন্য কোথাও যাওয়ার মতলব আছে নাকি?
বেনু যেন কথাগুলো শুনে বোবা হয়ে গেছে তার ঠোটে দুটো থরথর করে কাপছে, কিছু বলতে পারছে না। আপনার আসল নাম কি? কি আপনার পরিচয়? তাড়াতাড়ি বলুন, নইলে এখনই পুলিশে দেবো।
না না না আমাকে ওসব কথা বলবেন না আমি চোর নই, আমার বংশের কেউ এ কলংকে জড়িত নয়। আমি আমি আর বলতে পারেনা বেনু গলাটা তার শুকিয়ে গেছে। যন্ত্রনায় তার দেহমন ছটফট করতে থাকে।
কিন্তু কামালের ক্রোধ কমেনা কিছুতেই। মেয়েটির সব কান্না, সব মিস্টি কথাই আজ যেন মিথ্যে ছলনার ফাঁদ বলে মনে হয়। তাই সে ভাবছে যদি এই মুহুর্তে তার আসল ঘটনা উদঘাটন করা হয়ে যায় তবে তাকে আজ নিশ্চয় একটা উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। নইলে হয়ত সে সর্বনাশ করে ছাড়বে।
ওদিকে বুয়াটা যেন আনন্দে গদগদ। উৎসুক নয়নে চেয়ে আছে বেনুর এহেন কাজের শাস্তি দেখার জন্য। বেনু তার দিকে চোখ ফেলতেই বুয়াযেন কাচুমাচু করে সরে গেল। বেনুর এহেন পরিস্থিতিতে সুমতি ফিরে পেল যেন। তাই একরকম চিৎকার করে বলতে চাইল আমিও আপনাদের মত মানুষ। আমার আপনাদের মত বড় ঘরে জন্ম। কিন্তু ভাগ্যের জোড়ে আজ আপনার দ্বারস্থ।
কামাল কোন উত্তর না পেয়ে বেনুর দিকে রাগত নজরে তাকাল। বেনুর দৃষ্টি তার চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। সেই ভাবতে লাগল, সব মানুষগুলোই কি একই রকম। এখন যদি কিছুনা বলি হয়ত অন্য কোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই আমাকে এখনই কিছু বলা উচিৎ।
তাই শান্ত গলায় বেনু বলল, তাহলে শুনুন আমার কথাÑ আপনি যা মনে করেছেন আমি তা নই।
— তাহলে আপনি কি? কামাল বলল।
— আমি একজন আপনাদের মতই মানুষ।
— মানুষ তো সবাই, তাই কি হযেছে Ñ ভনিতা করবেন না।
আমার মনে পড়ছে আমার বিগত ফেলে আসা স্মৃতিগুলো।
— আমার আসল নাম জেসমীন আরা বেনু। আমার পিতার নাম সৈয়দ জাহিদ হাসান। তিনি একজন উর্দ্ধতন কালেক্টরেট কর্মকর্তা ছিলেন দিনাজপুরের। তিনি ছুটিতে রংপুরের গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি আমার মা মারা গেলে পরে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। সেই সৎমায়ের ছিল ভাই। সে ছিল অর্থ লোভী এবং সম্পদ লোভী। আব্বা তা পছন্দ করতনা এবং তাদের কে ঘৃণার চোখে দেখত। একদিন তিস্তার চরে ভোরে আব্বা যায় পাখি শিকারে। সেখান থেকে আব্বা আর ফেরত আসেনি। তাপপর আমার উপর নির্যাতন শুরু করে তারা।
সৎমায়ের সহযোগীতায় সম্পদ হরণ করার চেষ্টা করেন তারা। আমাকে নানাভাবে উৎপাত করতে থাকে। কিন্তু আমাকে কোন ভাবেই হাত করতে পারে না ওরা। এই জিনিষগুলো আমার জন্মদাত্রী মায়ের। ওই জিনিষের মধ্যে আছে আমার ছবি।
ওরা আমাকে হাত করতে না পেরে গৃহ বন্দী করে রাখে। এমন কি আমার উপর রাগ করে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমি ভাগ্যক্রমে সেখান থেকে বেঁচে গেলে তারা বলে আমি নাকি নিজে আত্মহত্যা করার জন্য নিজেই ঘরে আগুন দিয়েছি। আমি আর কিছু বলতে পারব না।
— ও জিনিষগুলো আমাকে দিন। আমি ওগুলো অনেক কষ্টে ও যতেœ লুকিয়ে রেখেছি। আমাকে আর কোন প্রশ্ন করবেন না। আমি আর পারছি না, মা গো মা। আর্তচিৎকারে সে মুষড়ে গেল এবং ধীরে ধীরে মাটিতে পড়ে গেল।
কামাল রাগত স্বরে বলল, এই বুয়া এখন ঠেলা সামলাও। তাড়াতাড়ি এসে ওকে ধর। কামাল নিজেও দৌড়ে এসে বেনুকে তুলে ধরল। বুয়াকে পানি আনতে বলল। মুখে পানি ছিটা দিল। কামাল বেনুর মাথা তুলে ধরে মুখের দিকে ভাল করে তাকাল, তার মনে হলো বেনু আসলেই একটা নিস্পাপ মহিলা।

(দুই)
ঘটনার প্রবাহ শুরুতে ছিল বেদনাদায়ক পরিস্থিতি। তখন ছিল বৈশাখ মাস। আকাশ গর্জন করছে। কালবৈশাখীর দিন হলেও বৃষ্টি ঝড়ছে আষাঢ়ী বৃস্টির মত। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট জনহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু বৃষ্টির থেমে যাওয়ার কোন লক্ষণ নেই। এদিকে বাড়ির সকলেই শুয়ে পড়েছে। হয়ত কেউ জেগে আছে নয়তো বা গভীর ঘুমে অচেতন এই মুহুর্তেই পালাতে হবে। তাই আনাথ মেয়েটি অতি সতর্কতার সহিত নিজের পোষাক পরিবর্তন করে নিল। নিজকে আয়নায় দেখল, হ্যা কাজের বুয়ার মত দেখা যায় আর কি।
রাত্রী প্রায় বারোটা বৈকি। এখনই যেতে হবে। তাই দুই রাকায়াত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে নিল। কাজের বুয়া তার পাহাড়ায় আছে। কিন্তু সেও বৃষ্টির আমেজে ঘুমে অচেতন। এখন দারোয়ান বেটা কি করছে। একবার দেখা দরকার। হ্যাঁ দারোয়ান বেটাও বৃষ্টির ঠান্ডা আমেজে ঘুমোচ্ছে।
অতি ধীরে সে পা চালাল। তার সব জিনিষ রেখে এসেছে। তবে যা নিয়ে আসার দরকার তা নিয়েছে। এবার কোথায় যাবে বাড়ির বাহিরে এসে একটু ভেবে নিল। তার পর সে হাঁটতে শুরু করল শহরের দিকে। কিছুদুর আসতেই তার মনে পরে গেল কাছেই রাস্তার ধারে এক বুড়ো রিকসাওয়ালার বাড়ি। সে তার বিষয়ে সব জানে এবং আব্বার এক কালের ভক্ত। আশা করি সে তার মঙ্গল কামনা করবে নিশ্চই। হ্যাঁ এই বাড়ি সেই চাচার।
চাচা করে ডাকতেই সেই রিক্সাওয়ালা হুরমুর করে উঠে পড়ল। কে কে এতরাতে? আলো জ্বালিয়ে সামনে এল। চাচা আমি বেনু।
— বেনু মা তুমি এতরাতে–?
— বেনু কান্না ভরা কণ্ঠে বলল, আপনি তো জানেন এখন আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচান। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, ওরা আমার সব নিয়ে নিবে।
— আচ্ছা মা কাঁদিস নাÑ তা কি করব বল মা? তোর বাবার লবন পানি বহুত খেয়েছি। মা বল কি করলে তা শোধ হবে?
— চাচা আমাকে ঢাকার বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে যান। আমি ঢাকা যাবো।
— আচ্ছা তাই যা মা তাই যা।
বুড়ো রিক্সায় নিয়ে শহরের দিকে রওয়ানা দিল। একদিকে কাঁচা রাস্তা অন্য দিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বুড়োর খুব কষ্ট হচ্ছিল। তথাপি বুড়ো তার মনিবের প্রতি একটু কর্তব্যের দায় সারতে রাজী।
ভোর ছয়টায় প্রথম বাস ঢাকার পথে ছাড়ে।
সাড়ে পাঁচটায় বুড়ো অতি কষ্টে রিক্সা টেনে টেনে রংপুর ঢাকা বাস স্ট্যান্ডে পৌছে গেল।
বেনু সারা রাস্তা আল্লার নাম জপতে ছিল যাতে কোন বিপদের সম্মুখীন না হয়। বুড়ো চাচা বলল, মা আমি বাস ছাড়া পর্যন্ত এখানে থেকে তোমাকে তুলে দেই।
— না চাচা আপনি যান। আপনি থাকলে কেউ যদি খুঁজতে এসে দেখে ফেলে। তার চেয়ে আপনি আমাকে দোয়া করেন চাচা যাতে আমি ইজ্জতের সাথে থাকতে পারি।
— সত্যি রিক্সাওয়ালা তার হাত খানি বেনুর মাথায় রেখে প্রাণ ভরে আল্লাহর নিকট কেঁদে দোয়া করল। ভাল থেক মা ভাল থেক।
এতো ভোরেও শহরের বাস স্ট্যান্ড যে সরগরম হয়ে উঠেছে। ঢাকার যাত্রীরা সব আসছে। কেউ আসছে তাদের প্রিয়জনকে বিদায় দিতে।
এই বাস স্ট্যান্ডটা শহরের মধ্যস্থলে হওয়ায় সব সময়ই ভীর থাকে। তার মধ্যে আবার চৌরাস্তা। জাহাজ কোম্পানীর মোড় বললে বোঝে ঢাকা বাসস্ট্যান্ড।
শহরের বাতিগুলো এখনো নিভেনি। কত লাল, নীল, রঙিন বাতি জ্বলছে। বাস স্ট্যন্ডে হকারগুলো গরম চা বাদাম নিয়ে ঘুরছে। বড় বড় দালানগুলোর গায়ে সিনেমার পোষ্টারগুলো দেখা যাচ্ছে। পোষ্টারের নগ্ন বেশে নায়িকা নায়কের গায়ে হেলান দিয়ে আছে। কোন পোষ্টারে আবার দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে আছে। কি বিশ্রী দৃশ্য। এসব দৃশ্য দেখলে যুবক শ্রেনীর চরিত্রের কি উন্নতি হবে, না অবনতি হবে। তার হিসেব কে রাখে?
টিকিট কাউন্টারে টিকিট দেয়া শুরু হয়েছে।
বেনু সারা রাত বৃষ্টিতে আধাভেজা হযেছে তাই একটু শীত শীত লাগছে আর শরীরটা একটু কাঁপছে। তবু কাঁপা শরীরে এগিয়ে গেল টিকেট নিতে।
— ভাইজান ঢাকার একটা টিকিট দেন।
টিকেট মাস্টার মেয়েটার দিকে দেখল আধাময়লা কাপড়ে একটি মহিলা, হয়ত কারো বাড়ির ঝি টি হবে। তা আবার শীতে কাঁপছে।
কাপড়ের গিট খুলে যখন টাকাটা কাউন্টারে দিল, তখন আধাময়লা টাকা দেখে লোকটা মনে করল কতদিনের না জানি সঞ্চিত টাকা।
— তা কি গো বেটি? তোমার সঙ্গে কেউ নেই? এতোদুর যাচ্ছো।
— খবর আসছে, বাপের খুব অসুখ ভাইজান।
— তাই যেতে হচ্ছে একাই। আমার সোয়ামী নাই, ভাই ব্রাদার নাই বলেই মেয়েটি কেঁদে ফেলল।
মেয়েটি এভাবে কাঁদবে টিকেট মাস্টার কল্পনা করেনি। কান্না দেখে তার মনটা নরম হলো। দরদ মাখা কন্ঠে বলল, আচ্ছা যাও যাও, কোন অসুবিধা হবেনা। তোমাকে ভাল সিট দিলাম।
লোকটা ঝুট ঝামেলা না করে তাড়াতাড়ি একটা টিকিট দিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরালো।
বেনু বোঝে এই বর্তমান উচ্ছৃংখল সমাজে মিথ্যার আশ্রয় না নিলে নিজের জীবনকে বাঁচান বড় দায়। যদিও মিথ্যা বলা মহা পাপ। কিন্তু সত্য বলতে গেলেই তার উদ্দেশ্য সফল হবেনা। সত্য কথা শুনে অনেকে উপকারের জন্য দাঁত বের করে আসবে, কিন্তু উপকারের বদল করবে নিজের স্বার্থ হাসিল। কাজেই আমি দুরে চলে যাওয়ার জন্য এসেছি। আমি দুরে গিয়ে দেখি আল্লাহ আমার কতটুকু সহায় হোন।
বাড়িতে দু’দিন হল ঝামেলা হচ্ছে। ভাল করে খাওয়াটা তার হয়নি। পুরো চব্বিশ ঘন্টা হলো তার মুখে দানাপানি যায়নি। পেটে ক্ষুধা দাউ দাউ করে জ্বলছে। দোকান পাট এত সকালে খোলেনি যে কিছু শুকনো খাবার কিনবে সে। টাকা পয়সাও নেই ভাল খাবার কিনে খাবে। এই টাকা তো সে বুয়ার কাছ থেকে এনেছে। পেটি কোটের ফিতার সেলাইয়ের মধ্যে তার মায়ের স্মৃতি টুকু লুকিয়ে এনেছে। এটা ওরা দেখলে হয়ত কেড়ে নিত আগেই। তার পেটটা ক্ষুধায় মোচর দিয়ে উঠছে। কিন্তু সামনে দুটো লোক তার দিকে বিশ্রী ভাবে তাকিয়ে আছে। তার ভীষন ভয় করছে। তাদের কোন কু মতলব রয়েছে কিনা। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে বাসে গিয়ে উঠি।
বাসের পাদানীতে পা রাখল সে, কন্ট্রাক্টর হেকে বসল টিকেট কই?
সে টিকিট দেখিয়ে বলল, ভাইজান, আমার বাপের অসুখ চিন্তায় আমার খাওয়া হয়নাই, শরীরটা খারাপ লাগছে, আমাকে একটু ভাল জায়গায় বসিয়ে দেন না ভাই?
কন্ট্রাকটর বলল, যাও ড্রাইভারের পিছনে জানালার কাছে সিটটায় বস।
কন্ট্রাক্টরের কথামত ড্রাইভারের পিছনের সিটে গিয়ে শাড়ীর আঁচলটা জড়িয়ে ভাল করে ঘোমটা টেনে বসে পড়ল।
কিন্তু তার শরীরটা তবু কাঁপছে। তার যন্ত্রনা সারা শরীরে। তার যন্ত্রনা মনে ও মাথায়। যন্ত্রনার ঢেউ আসছে যাচ্ছে। ওরা আমাকে বস করার জন্য মিথ্যা অসুখের নাম করে আমাকে ঘুমের ঔষুধ খাইয়েছে। এতো ঔষুধ খাইয়েছে যাতে জীবনে আর ঘুম না ছাড়ে। কিন্তু একি হল আমার দেহ মন থেকে ঘুম একেবারে ছেড়ে গেল কেন চিরদিনের জন্য।
এমন সময় বাসের পাশের সিটে এক ভদ্র লোক এসে বসল। সাথে বেশ কিছু মালামাল তুলে দিয়ে গেল এক লোক। ঢাকার পথে তিনি যাচ্ছেন বলে মনে হল।
এমন সময় বাস হুইসেল দিয়ে ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে বাসটি জাহাজ কোম্পানীর মোড় ঘুরে রওনা হল ঢাকার পথে। তখনও ঝির ঝির করে বৃষ্টি পরছে। জানালার পাশে বসে মেয়েটির বৃস্টির ঝাপটা ভালই লাগছিল। মনে মনে শহর কে বিদায় দিয়ে অনন্তের পথে যাত্রা দিল। মনকে বলল তুই যাচ্ছিস কোথায়? তোর চলার শেষ কোথায়? বৃষ্টিতে ভিজিস না, অসুখ করবে?
এ জীবনের কি দাম? তোর কথা কে শোনে? এ পৃথিবীতে বিচার কোথায়? মানবতা কোথায়? অতএব জীবন দিয়ে কি হবে?
এমন সময় কানে শব্দ ভেসে এল এই যে জানালার কাঁচটা টেনে দিন, বৃষ্টি আসছে যে। চমকে উঠল বেনু কে কথা বলে? চেয়ে দেখে পাশের সেই ভদ্রলোকটি তার দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে চেয়ে আছে। তার ভাবনায় ধাক্কা খেল। সে হাত দিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে লোকটির দিকে একটু দেখে নিল। পরে আবার নিজকে কাপড়ে ঢেকে চুপ করে থাকল।
তার আর খাওয়া হলো না। ক্ষুধায় ভাল লাগছে না, তাই চুপচাপ বসে রইল। ধীরে ধীরে সে ভাবনার রাজ্যে চলে গেল।
ভদ্রলোকটি মেয়েটির দিকে দীর্ঘ দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিল। সে ভাবতে লাগল। মুখ খানা দেখে মনে হয় মেয়েটি খুব ক্লান্ত। তার পোষাকে মনে হয় সে একজন দরিদ্র ঘরের মেয়ে। কিন্তু মুখখানা ও বসার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কোন শিক্ষিত ঘরের মেয়ে। ইচ্ছা হয় তাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে বাড়ি কোথায়, যাবে কোথায়?
তাই আবার মেয়েটির দিকে তাকাল। না মেয়েটি মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে আছে। তাই তার দিকে চেয়ে থাকা ঠিক হবে না। তাই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইলেন এবং ভাবতে লাগলেন।
(চলবে)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *